মূল্য সন্ত্রাস ॥ ম্লান হতে পারে সরকারের সকল অর্জন by শামীম মমতাজ
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়মতার মধ্যে নিয়ে আসা, প্রত্যেক পরিবারের একজন সদস্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা,
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিস্তৃত করা, ঘুষ-দুনর্ীতি, স্বজনপ্রীতি বন্ধ করে ভয়-ভীতিহীন স্বচ্ছ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিচার বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনকে সরকারের আজ্ঞাবহতা থেকে বের করে আনা, জ্বালানি সমস্যা তথা গ্যাস, বিদু্যত সঙ্কট দূর করা এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছিল নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এছাড়া জনগণের সমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার মতায় আসীন হলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধী, জেল হত্যা তথা জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং জঙ্গীবাদমুক্ত শান্তি ও সহনশীলতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। মহাজোট নেত্রীর সময়োপযোগী এ সকল প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়েই দিন বদলের প্রত্যাশায় জনগণ মহাজোটকে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী করে বসিয়েছিল মতার মসনদে। জনগণের দেয়া মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই সরকার মাত্র ৮ দিনের মাথায় সারের মূল্য ৫০% কমিয়ে দেয়। যা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে তথা কৃষিতে বিপ্লব আনতে সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবতর্ীতে ২ নবেম্বর ২০০৯ দ্বিতীয় দফায় ৩০০০ কোটি টাকা ভতর্ুকি দিয়ে সারের মূল্য গড়ে ৩৬% শতাংশ কমানো হয়, ডিজেলে নগদ অর্থ ভর্তুকি প্রদান, কৃষকের দোড় গোড়ায় হয়রানি মুক্ত করে কৃষি ঋণ পেঁৗছে দেয়া, সরকারী ক্রয় বাড়ানোর ল্যে নতুন খাদ্য গুদাম তৈরির উদ্যোগ, দেশের ১ কোটি ৮২ লাখ প্রকৃত কৃষক পরিবারের মধ্যে সরকারি ভতর্ুকি এবং সরকারি কৃষি উপকরণ সহায়তা প্রদানের ল্যে কার্ড বিতরণের ব্যবস্থা, শস্যবীমা চালুর কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আনা ল্য একটাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকের স্বার্থ রা করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় মতার মধ্যে আনা। কৃষি বিপ্লব ঘটানোর জন্য এ সকল কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে দাতা গোষ্ঠীর রক্তচু উপো করে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে তাদের দেয়া প্রেসক্রিপশন।জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটাতে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে যা দেশকে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে গড়ে তোলা তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী, যুগোপযোগী এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত কর্মমুখী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মানসে জাতীয় শিানীতি প্রণয়ন যা দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। দেশের সকল শিাপ্রতিষ্ঠানের শিার মান এক পর্যায়ে আনার ল্যে দেশব্যাপী অভিন্ন প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীা, বাড়ানো হয়েছে প্রাথমিক বৃত্তির সংখ্যা। সমাপনী পরীায় ঘোষিত মেধা তালিকার ভিত্তিতে ৫০ হাজার ৫৩৫ জন বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যে সুধীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মানসম্পন্ন শিা দিতে বিদ্যালয়গুলো যাতে শ্রেণীক েযথাযথ পাঠ দান করে তার জন্য ১৯৮০ সালের প্রণীত নোট ও গাইড বই বিক্রয় নিষিদ্ধ আইন সক্রিয় করেছে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সকল ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই প্রদানের কর্মসূচী গ্রহণ ও জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সকল শিার্থীর হাতে বই তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং সঙ্কট হলে ওয়েব সাইট থেকে বই ডাউনলোড করে ছাপার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় মতার মধ্যে আনা। এ ল্যে সরকার তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২০০৯ সালে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য মোটা চালের দাম সহনীয় পর্যায়েই নেমে এসেছিল বলা চলে। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই অকারণে ভরা মৌসুমে বাড়ছে চালের দাম। সরকার দাম কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেও হালে পানি পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে গুটি কয়েক মিল মালিক, আড়তদার ও সরকার দলীয় ব্যবসায়ী নেতার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে 'চাল সিন্ডিকেট'। তাদের কারসাজিতেই ২০ টাকার মোটা চাল এখন ২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারী ক্রয়সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দামও বেড়েছে আগের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। সরু চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চাল এমন একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য যার দামের ওপর নির্ভর করে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। সেই চালের দাম কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও অলিখিতভাবে বেড়ে যাবে।
চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কিছুিদন আগে দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় তদারক কমিটি ওএমএস চালু, টিআর ও কাবিখার মতো কর্মসূচী জোরদার করার সুপারিশ করেছে। ওমএস কর্মসূচী শ্রমঘন এলাকাতে চালু হলেও টিআর বা কাবিখার মতো কর্মসূচী চালু হয়েছে বলে জানা যায়নি। অন্যদিকে দৈনিক যায়যায়দিন গত ২৪ জানুয়ারি খবর ছেপেছে গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত খোলাবাজারের চাল (ওএমএস) নিয়ে শুরু হয়েছে নয়ছয়। এক ধরনের অসৎ ব্যবসায়ী (ডিলার) যাদের চাল বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাই এখন ওএমএসের চাল কালো বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ২২ টাকা দরের এ চাল পাইকার ও আড়তদারদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ২৪ টাকায়। যায়যায়দিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে চালের আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা ও মিলমালিকদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সরকারের বরাদ্দ করা খোলাবাজারের চাল কালো বাজারে চলে যাওয়ার কারণে সুফল পাচ্ছে না গরিব মানুষ। তেজগাঁও সরকারি গুদাম থেকে ডিলারের মাধ্যমে উত্তোলন করা চাল চলে যাচ্ছে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। ডিলারা মোটা চাল ২১ টাকায় গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছে বিক্রি না করে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করছেন ২৪ টাকা কেজি দরে। আর পাইকাররা সে চাল বিক্রি করছেন ২৬ থেকে ২৭ টাকা দরে। গত ২৩ জানুয়ারি মিরপুর ১ নম্বরে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, রাত ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে তেজগাঁও গুদাম থেকে চাল নিয়ে ট্রাক সরাসরি ঢুকে যাচ্ছে মিরপুর ১ নম্বর চালের আড়তে। একই মার্কেটের কয়েক আড়তদার জানিয়েছে, ডিলারের লোকজন এসে ওএমএসের চাল কেনার জন্য অনুরোধ করছে। দাম ২৪ টাকা কেজি। বিষয়টি বেআইনি হলেও এখন ওপেন-সিক্রেট হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষ দেখেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে সরকারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট কেটে নিয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা। তাই সাধারণ মানুষ যদি ধারণা করে, বর্তমান সরকারও এর ব্যতিক্রম নয় তাহলে তা বিশ্বাস করানো খুব কষ্ট হবে না। কারণ পাবলিক বাসে যাতায়াতের সুবাদে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা শুনেতে পাই, তাদের ভাষ্য বাণিজ্যমন্ত্রী কোন পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার পরের দিনই সেই পণ্যের দাম বাড়ে। এবার সরকার সমর্থক চালের ডিলারদের চৌর্যবৃত্তির খবর পত্রিকায় এসেছে। একদিকে সরকার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে দিচ্ছে ভতর্ুকিসহ সব ধরনের সহায়তা, পণ্য মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়মতার মধ্যে রাখতে সময় সময় তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে গাছেরটাও খাচ্ছে তলারটাও কুড়াচ্ছে। বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে কিংবা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে এবং চলবে। সরকার অসময়ে অনাকঙ্তি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে এর প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। যার প্রভাবে ম্লান হতে পারে সরকারের এক বছরের সকল অর্জন।
No comments