স্মরণ- আতাউল গনি ওসমানী by দুলাল আচার্য

আতাউল গনি ওসমানী। এম এ জি ওসমানী নামে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি। কর্মজীবন শুরু করেন সেনাবাহিনীর একজন কমিশন অফিসার হিসেবে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ (শেষ পবর্) অধ্যয়নকালেই তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন, ১৯৪২ সালে মেজর এবং ১৯৫৭ সালে তিনি কর্নেল পদে উত্তীর্ণ হন। এখানে উল্লেখ্য, বাঙালীদের মধ্যে জেনারেল ওসমানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানী সেনা বাহিনীতে অন্তভর্ুক্ত হন। প্রত্য করেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালীদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ। বাঙালী অফিসার হিসেবে তিনি নিজেও সেনা বাহিনীর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন। ১৯৭০ সালে জেনারেল ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাথর্ী হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী জেনারেল ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তাঁকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেই থেকে তিনি জেনারেল পদমর্যাদায় আসীন হন। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে তাঁর নেতৃত্বেই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাঁর অধীনেই 'এস'-ফোর্স, 'কে'-ফোর্স এবং 'জেড'-ফোর্স গঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল পদ বিলুপ্ত হলে জেনারেল ওসমানী আবারও সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হন। ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। জেনারেল ওসমানী পরে ডাক, তার, টেলিফোন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের ১ মে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠিত হলে তিনি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর একই বছরের ২৯ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতির প্রতিরা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ৩ নবেম্বর তিনি তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি 'জনতা দল' গঠন করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রাথর্ী হিসেবে প্রতিদ্বন্দি্বতা করে আলোচিত হন। সামরিক সরকারের ছকেবাঁধা সেই নির্বাচনটি ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতা, সেটা তিনি নির্বাচনের পর অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৪ নবেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও জেনারেল ওসমানী নাগরিক কমিটি প্রাথর্ী হিসেবে প্রতিদ্বন্দি্বতা করেন।
আতাউল গনি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ নবেম্বর বৃহত্তর সিলেট জেলা বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। সেনাবাহিনীতে চাকরিকালীন সময়ে তিনি চট্টগ্রাম সেনা নিবাস প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ওসমানী ইন্তেকাল করেন।
রাজনীতিবিদ হিসেবে জেনারেল ওসমানী আলোচিত-সমালোচিত হলেও একজন দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনন্যতায় উজ্জ্বল। ইতিহাসে তিনি তাঁর যথাযোগ্য স্থান পাবেন

No comments

Powered by Blogger.