সাহসের সমাচারঃ নাম হবে তেপান্তর by আল মাহমুদ

সব কথার শেষ কথা হলো, লেখাটাই আমার কাজ। এটা বোঝার পর আমি সমালোচনার ঘনঘটা তুচ্ছ করে চলতে চেয়েছি। তবুও আমারও যে সমালোচক নেই এমন নয়। তবে বাড়ি বয়ে এসে আমাকে আঙুল তুলে তিরস্কার বড় একটা কেউ করে না।
এতে আমি খানিকটা নিরাপত্তার মধ্যে আছি বলেই ধারণা হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, লিখতে না জানলে আমার কী দশা হতো! কখনও মনে হয় কিছুই হতো না। কে এক লেখক কী সমস্যায় পড়েছে, এটা কারও ভাবনার বিষয় হতে পারে না। অনেক সময় অনিচ্ছাতেও লিখতে হয়। সেসব লেখা আমি আর ফিরে দেখি না। অথচ অনিচ্ছাতে যা লেখা হয় সেটারও পাঠক আছে। তাছাড়া লেখাটার পরাক্রমও আছে। সে হয়তো কারও মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। এসব নিয়ে সদাসর্বদা ভাবলে লেখার গতি কমে যায়। আমি ভাবি না, একথা বলব না। আমি ভাবি, তবে খুব বেশিক্ষণ এ নিয়ে মেতে থাকি না। আমি জানি, আমার কিছু পাঠক আছে। কিন্তু পাঠক না থাকলে আমি কি লিখতাম না? হয়তো লিখতাম। কিন্তু লেখা থেকে যে শিক্ষা হয় সেটা শিখতাম না।
আমি এখন লিখলেই কিছু শিখতে চাই। অথচ কী শিখব, কার কাছে শিখব? কেউ তো আমার শিক্ষক হতে চায় না। বিষয়টা এমন যে, যেন আমার চেয়ে বেশি জানে এমন কেউ আশপাশে বিরাজ করে না। আমার অবশ্য সময় কাটাতে হলে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করে তৈরি থাকতে হয়। আমার জ্ঞান আমাকে বার বার ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে। বলে, যথেষ্ট হয়েছে। আমি আমারই জ্ঞান এবং বুদ্ধিবৃত্তির চেহারাটা দেখে ফেলি। মুহূর্তে মনে হয়, নির্বুদ্ধিতাই আমাকে চালাচ্ছে। আমি চলতে চাই। কিন্তু নির্বুদ্ধিতার ধাক্কা খেয়ে নয়। ধাক্কা মারুক তো বুদ্ধি এসে ধাক্কা মারুক। কিন্তু আমাকে কেউ ধাক্কা মারতে চায় না। কেন ধাক্কা মারতে চায় না এ প্রশ্ন করতে গেলে মুখ ফিরিয়ে দেখি কেউ নেই। কিন্তু হাওয়ায় ভাসছে মুচকি হাসি। বলে, পড়ে যাবে। পড়ে গেলে তোমাকে তুলবে কে? আমি চতুর্দিকটা দেখে নিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলি, কেউ নেই। কিছু নেই।
শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বয়ে যায়। গাছের পাতারা নড়ে। আর একই সঙ্গে দু’একটা হলদে পাতা আমার মুখে এসে লাগে। আমি ভাবি এই ঝরে যাওয়া—এটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য। কে সব সময় বোঁটায় থাকতে চায়? জগতটা হলো সর্বক্ষণ ঝরে যাওয়ার শব্দে তন্ময়। ঝরো ঝরো ঝরো—এই শব্দ আমার চারদিকে ক্রমাগত বয়ে চলেছে। আমি এই ঝরার ঝরোকায় খাবি খেতে থাকি। এর মধ্যেই রয়েছে হয়তোবা জীবনের কোনো অর্থ। আমি ধরতে পারি না। কোনো কিছু গড়তেও পারি না। তবু লোকে আমাকে সৃজনশীল মানুষই বলে। হয়তোবা আমার কিছু কবিতায়-গল্পে খানিকটা উদ্ভাবনা এর আগে কাজ করেছে। ফলে আমার প্রতি পরিবেশের একটা পক্ষপাত আছে।
আমি এখন আমাকেই ভাঙিয়ে খরচ করে ফেলতে চাই। কী মিলবে জানি না। কিন্তু নিজকে খরচ করার একটা উন্মাদনা আমার মধ্যে কাজ করে চলেছে। আমি সারা জীবন কিনেছি। বিক্রি তো করিনি কিছু। এখন বেচার নেশা আমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, আমি আর কিনব না। বেচব। প্রশ্ন হলো, বেচতে গেলে প্রথমেই এসে যায় কী বেচব। আমার নাম? হ্যাঁ, এটা একটা বিষয় বটে। আমার ধাম? আসলে তো আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই। আর থাকে কাম। এই একটা বিষয় আছে। আমি কাজ করেছি। কাজের পরে ভাঁজ করেছি। এখন দেখতে পাচ্ছি, অনেক কিছুই ভাঁজের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে। আসলে ভাঁজ খুলতে হলে মানুষের সমস্ত সন্ধিস্থল আলগা হয়ে যায়।
তবু জীবনের যে পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছি—এখানে দাঁড়ালে সবাই বলে খোলো, খোলো, খোলো। আমি খুলতে চাই। খুলতে গেলেই বেরিয়ে পড়ে আমার জীবনের সমস্ত জটিলতা। হায় আমি এত মিথ্যাবাদী ছিলাম? কখনও মনে হয় আমি কেন এত সত্যবাদী ছিলাম। সত্য-মিথ্যায় মিলিয়ে আমার জীবন খাতার সব পাতা জোড়া লেগে গেছে। আস্তে খুলতে হবে। তবু আমি খুলব। একটি পাতা সরাতেই দেখি এখানে আমার হৃিপণ্ড। ধুক্ধুক্ করছে। আমি বললাম, এখানে কী হচ্ছে?
কে যেন আড়াল থেকে হেসে বলল, কলের গান হচ্ছে। আমি শুনতে পেলাম কলের সঙ্গীত থেকে বেরিয়ে আসছে আমারই কণ্ঠস্বর। মধুর এবং একই সঙ্গে বিমর্ষতায় ভরা। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কেউ যেন আমাকে জানান দেয়ার জন্য ফিক করে হেসে ফেলল। নারীকণ্ঠ। আমি প্রশ্ন করলাম, কে তুমি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তোমাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি না। অথচ তোমার মনে হচ্ছে কেউ তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে তোমার স্থানান্তর হচ্ছে। তুমি আর তোমার ধারণার মধ্যে থাকতে পারছ না। দেখছ না তোমার হাত-পা বেরিয়ে পড়ছে। তুমি তোমার চেয়ে বড় হয়ে গেছ। ধরানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আমরা সাধারণত কেটে ছোট করে দিই। কিন্তু তুমি তো আবার মানুষ। কাটলে রক্ত ঝরবে। তোমাকে কাটবও না, ছাঁটবও না। অথচ তোমাকে ভাগ করে দেয়া একান্ত জরুরি।
এবার আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম। আমাকে অকাট্য এবং আস্ত রাখতে হলে আমার আয়তন আমার চেয়ে একটু বাড়িয়ে দিতে হবে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, আমি পাত্রের চেয়ে প্রবল এবং পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছি। জায়গা ছেড়ে দাও। আমার জন্য প্রসারিত কর। আমার কথা শুনে সবারই অক্ষমতা তড়বড়িয়ে উঠল। সবাই ফিসফিস করছে। জায়গা কোথায়? অথচ আমার জন্য একটা বিশাল প্রান্তর দরকার। যার নাম হবে তেপান্তর।
লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.