মহাপ্রলয়ের ঢাক by সুভাষ সাহা

আজই কি ঘটতে যাচ্ছে মহাপ্রলয়! চীনের ২০ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, ২১ ডিসেম্বর সৃষ্টির অপরূপ মাধুরী মেশানো রূপ-রস-গন্ধে ভরা এই ধরিত্রীর মহানিদানের দিন। যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের মানুষরা আরও বেশি সংখ্যায় রোজ কিয়ামতের ক্ষণ হিসেবে এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার তত্ত্ব বিশ্বাসে অটল।
অনেকে মনে করেন, নিবুরু নামের এক রহস্যময় গ্রহ আমাদের প্রিয় পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়ে একে ধ্বংস করে দেবে। এ সময় দুটি গ্রহের মধ্যকার সংঘর্ষে বিপুল সৌর বিকিরণে সবকিছু ঝলসে যাবে। আর কেউ কেউ মনে করেন, এর ফলে পৃথিবীতে অকস্মাৎ অন্ধকার নেমে আসবে। পানির উচ্চতা বিপুল মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মহাপ্রলয়ের মিথ অনুসরণে কেউ কেউ বিরাট আকারের ভিন্ন ধরনের ভেসে থাকার পডও তৈরি করে ফেলেছেন। চীনের মধ্য হেবেই প্রদেশের ৪৫ বছর বয়স্ক লি কুইয়ান ইতিমধ্যে এ ধরনের চারটি পড তৈরি করে সেরেছেন। এসব পড এক হাজার মিটার উচ্চতার সুনামির সময়ও ভেসে থাকার ব্যবস্থা করবে। প্রতিটি পডে ১৪ জন করে উঠতে পারবেন। তাই মহাপ্রলয় সংবাদে এখন নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবনসহ সবকিছু খোয়ানোর চিন্তাটা লি কুইয়ানকে আর আচ্ছন্ন করছে না। প্রতিটি পড তৈরি করতে লির ৩০ হাজার ডলার খরচ পড়েছে। ফাইবার গ্গ্নাস ও স্টিলের ফ্রেম দিয়ে তৈরি পডগুলোর ভেতরে অক্সিজেন প্রবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। আর কয়েকদিন টিকে থাকার মতো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা তো থাকছেই।
চীনের সাধারণ মানুষ তাদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিপুল সংখ্যায় মোমবাতি এনে জড়ো করছে। কারণ অধিকাংশ মানুষ মনে করছে, রোজ কিয়ামত ঘটুক আর না-ই ঘটুক পৃথিবীতে কিছু সময়ের জন্য অন্ধকার তো নেমে আসতে পারে! তারা মনে করেন, অন্তত তিন দিন সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করা যাবে। আসলে মোমবাতির সঙ্গে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের একটা সম্পর্ক রয়েছে কি-না! সাংহাইয়ের ৬৫ বছর বয়স্ক ঝাও ল্যানিং বললেন, তিনি এদিনের জন্য ১০ বাক্স দিয়াশলাই কিনেছেন। আর এ ধরনের একটি দিনের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় চীনের ৩৪ বছর বয়স্ক কম্পিউটার টেকনিশিয়ান চেন হাও। তিনি একটি গুহা তৈরি করেছেন। তার মতে, অনেকের কাছে এটা জোক মনে হতে পারে। কিন্তু যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তার কাছে মনে হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা এই মহাপ্রলয় তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ২১ ডিসেম্বর কেন, অদূর ভবিষ্যতেও পৃথিবী ধ্বংসের কোনো কারণ নেই। চীন সরকারও মানুষের এই অন্ধ বিশ্বাসকে মানছে না। তারা এ ধরনের গুজবে কান না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এ জন্য চীনে ইতিমধ্যে সাড়ে চারশ' থেকে পাঁচশ' জনকে গুজব রটনাকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। মহাপ্রলয়ের অনেকগুলো তত্ত্বের অধিকাংশের উৎস প্রাচীন মায়া ক্যালেন্ডার। এই সভ্যতার ধারকরা সেই আদিকালেই পাঁচ হাজার বছর পর্যন্ত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে গেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলো খেটেও গেছে। এই মায়া ক্যালেন্ডার সম্পর্কে যারা গবেষণা করেছেন তারা মনে করেন, ওই ক্যালেন্ডার বা তাদের ভবিষ্যৎ বাচ্যতা অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংসের কোনো দিকনির্দেশ নেই। সেখানে নতুন সময়চক্র শুরুর কথাই বলা হয়েছে। এ সময়চক্র অবশ্যই উন্নততর মানব সমাজেরই দিকনির্দেশ করে। অন্যতম প্রত্নতত্ত্ব খননকারী উইলিয়াম সতুর্ন মনে করেন, মায়ারা কখনও পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলতে পারেন না। তারা নতুন ও উন্নততর ভবিষ্যৎ শুরুর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। নাসা সুস্পষ্টভাবেই বলেছে, পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে না। যারা মহাপ্রলয়ের এই কল্পকাহিনীতে বিশ্বাস স্থাপন করছে, তাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি এবং তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে নাসার বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন।

No comments

Powered by Blogger.