হরতালের পর হরতাল-জ্বালাও-পোড়াওয়ের অবসান প্রয়োজন

জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে চারটি ইসলামী দল গতকাল ঢাকায় আট ঘণ্টা ও সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। ঢিলেঢালা এই হরতালের সময় বেশ কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। নগরীর ভেতরে কিছু বাস চলাচল করলেও ভাঙচুরের ভয়ে দূরপাল্লার বাস চলাচল করেনি।
ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। সারা দেশে পণ্য পরিবহনও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ হরতালের আগের দিনও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। সেদিনও রাজশাহী ও সিলেটে জামায়াত-শিবির হরতাল ডেকেছিল। বগুড়ায় একটি তুলাবাহী ট্রাকে আগুন দেওয়াসহ বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু কেন এই উপর্যুপরি হরতাল? কিংবা হরতালের নামে কেন এই নাশকতা?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় আসন্ন দেখে জামায়াতে ইসলামী হঠাৎই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে এর আগেও তারা একাধিক হরতাল ডেকেছে। সেসব হরতালের সময় নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়েছে। বোমাবাজি-গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। কাজেই আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়েই সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু কেন? যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি তো গণমানুষের দাবি। বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রধান অঙ্গীকার ছিল, ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবে। আর সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়যুক্ত করেছিল। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি কোনো দলের দাবি নয়, একে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবি হিসেবেই দেখতে হবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, স্বাধীনতাকামী মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক-শিক্ষিকা, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তাদের কৃতকর্মের জন্য তারা কখনো দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, বরং এখনো তারা পুরনো ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্ম-মতের মানুষ একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চেয়েছি। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী জামায়াতের নেতৃত্বে কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবারই আমাদের এ অর্জনকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। বিগত জোট সরকারের সময় সারা দেশে জঙ্গিবাদকে যেভাবে উসকে দেওয়া হয়েছিল, যেভাবে বোমাবাজি ও মানুষ হত্যা শুরু হয়েছিল, তাতে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বর্বর বোমা হামলার দেশ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানকেও আমরা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। আর এই জঙ্গি উত্থানেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল জামায়াত-শিবিরের স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তাদেরই মদদে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইদের নেতৃত্বে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে জেএমবি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বর্তমানে সেই জঙ্গিবাদ থেকে দেশ অনেকটাই মুক্ত। আর সেটিই কি জামায়াতের এত গাত্রদাহের কারণ? সারা দেশে একযোগে পাঁচ শতাধিক স্থানে বোমা হামলা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার এমপিকে হত্যা, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা, ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলা, বিচারক-আইনজীবী হত্যার মতো ঘটনা এসব অপশক্তির দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছিল।
বৈশ্বিক মন্দা উপেক্ষা এবং বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। আমরা উন্নয়নের সেই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। আর সে জন্য দেশে অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হবে। যেকোনো অন্ধকারের শক্তিকে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.