বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬০৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ বাংকারে গ্রেনেড ছোড়ার সময় কপালে গুলি লাগে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের মেহেদীপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে।
তাঁরা ছিলেন তিনটি দলে। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৩ ডিসেম্বর রাতে তাঁরা শহরের কাছাকাছি পৌঁছান। পথে শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তেমন সাড়া তাঁরা পাননি।
এরপর মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তাঁর দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাতেই মহানন্দা অতিক্রম করে অবস্থান নেন রেহাইচরে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাকি দুই দলের একটি বালিয়াডাঙ্গায় নদী অতিক্রম করে অবস্থান নেয়। অপর দল কালীনগর ঘাট দিয়ে নদী অতিক্রম করে আক্রমণ চালায়।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন, তার অদূরেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে আক্রমণ চালান। তবে তাঁর সহযোদ্ধারা তেমন সুবিধা করতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনারা নিজ নিজ প্রতিরক্ষায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কোনো ব্রেক-থ্রু না হওয়ায় মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কিছুটা মরিয়া ও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তখন তিনি নিজেই ক্রল করে একটি বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। ওই বাংকারে ছিল পাকিস্তানিদের এলএমজি পোস্ট। তাঁর লক্ষ্য ছিল গ্রেনেড ছুড়ে ওই বাংকার ধ্বংস করা।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ওই বাংকারের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। কিন্তু গ্রেনেড ছোড়ার মুহূর্তে কাছাকাছি আরেক বাংকারে থাকা পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখে ফেলে। তারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। একটি গুলি এসে তাঁর কপালে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিভে যায় তাঁর প্রাণবায়ু। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন তিনি।
তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার পর আত্মপ্রত্যয়ী মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের সাঁড়াশি আক্রমণ চালান এবং তুমুল যুদ্ধের পর সেদিনই চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ উদ্ধার করে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধি চিহ্নিত।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। এর অবস্থান ছিল পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কারাকোরামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
অবশেষে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনিসহ চারজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে গোপনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। সীমান্ত অতিক্রমের পর বিএসএফের সহায়তায় কলকাতায় মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান। তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে ৭ নম্বর সেক্টরের মেহেদীপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আওতাধীন এলাকা ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, কলাবাড়ী, সোবরা, কানসাট ও বারঘরিয়া এলাকা। তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় এ এলাকায় অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে কলাবাড়ী ও নবাবগঞ্জ, সোনামসজিদ আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। মেহেদীপুর সাবসেক্টর এলাকায় পাকিস্তানিদের কাছে তিনি মূর্তিমান এক আতঙ্ক ছিলেন।
১৪ নভেম্বর সোনামসজিদ মুক্ত হয়। সেদিন ভোরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সোনামসজিদে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আকস্মিক আক্রমণে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হকচকিত অবস্থা কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। জাহাঙ্গীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ১১ জন নিহত ও পাঁচজন বন্দী হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ০১।
শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার, মা মোছা. সুফিয়া খাতুন।
শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়িতে কয়েক বছর আগে সরকারি উদ্যোগে তাঁর নামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধি সাইফুর রহমান, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.