‘ছাত্রনং অর্থনং তপঃ’ by ফ্লোরা সরকার

গত ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস গেল। আর ঘটনাটা ঘটল ঠিক তার চারদিন পর, অর্থাত্ গত ১২ মার্চ, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়—‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ অর্থাত্ ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা অধ্যয়ন করা। শব্দটা তপঃ অর্থাত্ তপস্যা।
শুধু অধ্যয়ন নয়, সেই সঙ্গে তপস্যার সঙ্গে অধ্যয়ন করার কথা বলা হয়েছে। তপস্যা অর্থ নিবিষ্ট চিত্তে, পৃথিবীর সব কোলাহল থেকে, সব বাজে কাজ থেকে মুক্ত রেখে নিজেকে নিমজ্জিত রাখা। কোথায় নিমজ্জিত রাখা? অধ্যয়নে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের ছাত্রাবস্থায় অধ্যয়ন ছাড়া আর কোনো কাজ করবে না। কেন? কারণ ছাত্রজীবন নিজের ভবিষ্যত্ প্রস্তুতির সময়। কী ধরনের প্রস্তুতি? যাতে তারা মানুষ হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। যে মানুষের ভেতর চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বদৃষ্টি ইত্যাদি থাকে। এই সুবর্ণ সময়টি জীবনে আর কখনও আসে না, আসবে না। তাই এই সময়টিকে সঠিকভাবে সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে উল্লিখিত বাক্যটি আমাদের শেখানো হয়। তবে হ্যাঁ, পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরা আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও মনোনিবেশ করবে, যেমন—দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞাননীতি, ইতিহাসনীতি, সংস্কৃতিনীতি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ শুধু বই পড়ে যেমন সার্বিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়, আবার বইহীন অন্যান্য বিষয় জেনেও কেউ সার্বিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না এবং ব্যক্তি তথা সমাজের বিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এই সার্বিক জ্ঞানের অন্যতম একটি অংশ ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রছাত্রীরাই যেহেতু একটা দেশের ভবিষ্যত্ কর্ণধার, কাজেই ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞান রাখা এবং ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট রাখা অবশ্য প্রয়োজন। এই পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি যখন ছাত্র অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তখন? যদি ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’র পরিবর্তে ‘ছাত্রনং অর্থনং তপঃ’ হয়ে যায়, তখন? তখন কি কোনো শুভ লক্ষণ আমরা দেখতে পাই? না। অবশ্যই অশুভ লক্ষণ। শুধু অশুভ বললে সঠিক হয় না, একটা ভয়াবহতার চিত্র ফুটে ওঠে। আর এই চিত্রটিই গত ১২ মার্চ, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হঠাত্ বুমেরাং-এর মতো বের হয়ে এসেছে। গত ১৩ মার্চ, দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় খবরটি ছাপা হয় এবং দৈনিক আমার দেশের শেষ পৃষ্ঠায় শিরোনামটি ছিল—‘দেহব্যবসা নিয়ে ইডেনে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১০।’ খবরের বিস্তারিত জানার আগেই শিরোনামটি আঁতকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয় কি? আমরা সবাই জানি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়ার জায়গা, সেখানে কোনো ধরনের ব্যবসার বা বাণিজ্যের প্রশ্নই ওঠে না, দেহব্যবসা তো অনেক দূরে। কিন্তু না, এই দেহব্যবসার ইতিহাস খুব বেশি দূরের নয়। আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই তাহলেই স্মরণ কতে পারব এই বাণিজ্য শুরু হয়েছিল ১৯৮১-৮২ সাল থেকে। তবে সাধারণ কলেজ থেকে কিন্তু এর উত্পত্তি ঘটেনি, বিদ্যার সর্বোচ্চ পাদপীঠ বলে পরিচিত সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এর যাত্রা শুরু। যা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে চলতে থাকে, তবে গোপনে। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এর উত্থানের খবর জনে জনে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ততদিনে শিক্ষাঙ্গনের এই বাণিজ্য তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন কলেজের আনাচে-কানাচে। শুধু তাই না, শিক্ষাঙ্গন যেন বাণিজ্যাঙ্গনে রূপান্তর লাভ করে ফেলেছে। আর বাণিজ্য এমনই এক মহাক্ষমতাবান বস্তু যে এর পরিধির কেবল বিস্তার ঘটে, কখনোই সঙ্কুচিত হয় না, তাও দেহবাণিজ্যের মতো আদিম বিনিয়োগবিহীন বাণিজ্য। বিনিয়োগবিহীন কেন? কারণ এই বাণিজ্যে কোনো পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু একটি মেয়ের সর্বোচ্চ সম্ভ্রমটুকু বিনিয়োগ করতে হয়। আর সম্ভ্রম, সম্মান, আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান অর্থনীতির পুঁজি বিনিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। যারা এই বিনিয়োগে রাজি হয় না, তাদের হল থেকে এমনকি পড়াশোনা থেকে পর্যন্ত বহিষ্কৃত করা হয়। কাজেই এখন পড়াশোনা করতে হলে শুধু হাজার হাজার টাকা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে হলের সিট পেয়েই কোনো মেয়ে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করতে পারবে না, তাকে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকতে হবে কখন, কোন্ রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর বাড়িতে তার সেই সম্ভ্রম বিনিয়োগের জন্যে যেতে হবে। সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাইলে সে পড়াশোনা করতে পারবে না আর পড়াশোনা করতে হলে সম্ভ্রম রক্ষা করা চলবে না। বা! কি চমত্কার হিসাব। এ যেন গণিতের যোগ-বিয়োগের মতো। খুব সহজ, খুব সরল। আর এই সহজ অঙ্কগুলো কিন্তু করতে হয় গ্রাম বা ছোট শহর থেকে আগত সরল ছাত্রছাত্রীদের। যাদের বাবা-মায়েরা তাদের অনেক কষ্টে অর্জিত আয়ের টাকা দিয়ে, অনেক আশা নিয়ে, অনেক ভালো লেখাপড়া করার অভিপ্রায়ে তাদের সন্তানদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে প্রেরণ করেন। কোনো ধরনের বাণিজ্য করার জন্য প্রেরণ করেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সন্তানেরাই কিন্তু বাণিজ্যের ফটকা কারবারে আটকা পড়ে যায়। অর্থনীতিতে ঙঢ়ঢ়ড়ত্ঃঁহরঃু পড়ংঃ ঃযবড়ত্ু বা সুযোগ ব্যয় তত্ত্ব নামে একটি তত্ত্ব আছে। যেখানে, দুই বা ততোধিক কাজের সুযোগ থাকলেও যে কোনো একটি বেছে নিতে হয়। যেমন এক খণ্ড জমিতে কেউ ইচ্ছে করলে চাষের কাজ করতে পারে বা কারখানা নির্মাণ বা স্কুল, কলেজ নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু একই জমিতে উল্লিখিত সব কাজ একই সঙ্গে করার কোনো সুযোগ নেই। গ্রাম বা ছোট শহর থেকে আগত নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এসব ছাত্রছাত্রীর কিন্তু সেই সুযোগটি আছে। যেসব পরিবারের সন্তানেরা স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাটের আর্থ-রাজনীতির শিকার। যারা একদিকে যেমন জমি, ঘরবাড়ি হারাচ্ছে তেমনি হারাচ্ছে নৈতিক ও মানবিক শক্তি। লুটপাটের রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘেরাটোপে এরা বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি মিটিং, মিছিল থেকে শুরু করে নেতা বা মন্ত্রীদের বাগানবাড়ি বা গোপন বাড়িতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশেষত ছাত্রীদের যাতায়াত। শহরের তথাকথিত এলিট বা বুর্জোয়া ছাত্রছাত্রীদের কিন্তু এই অংকটি করতে হয় না। কারণ তাদের হলের পরিবর্তে আছে বিশাল ছাদওয়ালা বাড়ি, ভর্তির পরেও সম্ভ্রম বিনিয়োগের জন্য ছাত্রীদের কাছে কেউ যেতে সাহস পায় না, কারণ বুর্জোয়া ছাত্রীদের সম্ভ্রম অরক্ষিত রাখার, উন্মুক্ত করার, পড়াশোনা করার সুযোগ ব্যয়টি আছে। যেমন আজকাল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিট বা বুর্জোয়া ছাত্রছাত্রীরা করে থাকে। তারা তাদের বাবা-মায়ের বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা সুযোগ মতো ব্যয় করার স্বাধীনতা ভোগ করে।
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায় এই গ্রাম বা ছোট শহর থেকে আগত ছাত্রছাত্রীদের যারা ব্যবহার করছে, যাদের সরলতা আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী নামধারী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুখোশ পরে কোটি কোটি টাকা উপার্জনের মসৃণ পথ করে নিচ্ছে। এখানে তিনটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ—
১. নামধারী। ২. মুখোশ। ৩.মসৃণ পথ।
প্রথমেই দেখা যাক, নামধারী কেন। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ইডেনে সংঘটিত ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এসব ছাত্রীর ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তারা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদে বহাল তবিয়তে থেকে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো ছাত্রীর ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলে তো কলেজ থেকেই তার চলে যাওয়ার কথা, সেখানে ছাত্রী হিসেবে কীভাবে নাম বজায় রাখে তা বোধগম্য না হলেও এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কলেজ প্রশাসনের প্রশ্রয় ছাড়া তারা ছাত্রী সেজে কেউ থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, এসব ছাত্রছাত্রী কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখোশের আড়ালে অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকার বাণিজ্য করে। এরা না ছাত্র রাজনীতি করে, না পড়াশোনা করে। কারণ প্রকৃত রাজনীতির অর্থ সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য বা দেহবাণিজ্য নয়। যারা রাজনীতি করেন তারা বিষয়টি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত আছেন।
তৃতীয়ত, এসব কাজের জন্য তাদের কোনো বন্ধুর পথ ধরে এগিয়ে যেতে হয় না। তারা
মসৃণ পথে এগিয়ে যায়। মসৃণ কেন? কারণ কলেজ প্রশাসন এসব কাজে কোনো ধরনের বাধা প্রদান করে না, পাছে তাদের ঢাকার লোভনীয় পোস্টিংটি অন্যত্র পোস্টেড হওয়াসহ চাকরি বজায় রাখতে গিয়ে আনুষঙ্গিক অন্যান্য শঙ্কার মধ্যেও পড়তে হয়। শঙ্কা। অর্থাত্ ছাত্রছাত্রীরা এখন শিক্ষকদের ভয় করে না, শিক্ষকরাই বরং তাদের ভয় করেন। শুধু ভয় না, সমীহ করে চলেন। অর্থাত্ শ্রদ্ধার সংজ্ঞাও এই তথাকথিত ছাত্ররাজনীতিকরা বদলে দিচ্ছে। কালো সাদাকে সমীহ করবে না, সাদা কালোকে সমীহ করে চলবে।
এ যেন এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার দিকে আমরা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে কালো রং ছাড়া আর কোনো রং থাকবে না। অবশ্য কালো রংয়ের একটা শক্তিশালী ক্ষমতা আছে, সব রংকে শুষে নিতে জানে। আর এভাবেই যদি কালো রং সব রংকে ক্রমাগত শুষে নিতে থাকে তখন শুধু অন্ধকার থাকবে। আলোকিত মানুষ চাই এর স্লোগান কোনো কাজে আসবে না। আলোর দেখা পাওয়া তো অনেক দূরে।

No comments

Powered by Blogger.