ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে সঙ্কটঃ গভর্নিংবডি অভিযুক্ত

একদা বামপন্থী বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তার মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে কঠোর বাক্য উচ্চারণ করার পরও কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধানে সেখানকার শিক্ষকরা এখন সরাসরি শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিংবডির সঙ্গে শিক্ষকদের বিরোধের ফলেই এ সঙ্কট। আর গভর্নিংবডির সভাপতি হচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, যিনি মহাজোটের শরিক একটি বাম দলের সভাপতি। একইসঙ্গে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও সভাপতি। গতকালের আমার দেশসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট শিক্ষা খাতে বিরাজমান দুর্নীতি-অনিয়মের এমন চিত্রই তুলে ধরেছে। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৪টি শাখায় সর্বমোট সাড়ে ১৬ হাজার ছাত্রী এবং চার শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৫-৪০ শতাংশই সুপারিশের মাধ্যমে ভর্তি হয় বলে জানা গেছে। দিনবদলের সরকারের আমলেও এ অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এবারও পাঁচ শতাধিক ছাত্রীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি করার পরও গভর্নিংবডির সভাপতির অতিরিক্ত সুপারিশ পূরণ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে চরম বিপদে পড়তে হয়েছে। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় ১০ মাস আগেই তাকে গায়ের জোরে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন সভাপতি। কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই তাকে অপসারণের চিঠি দেয়া হয়েছে। ছয়জন সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে যাকে তার পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তিনি এখন নিজেকে ভিকটিমাইজড মনে করছেন। কারণ, গভর্নিংবডির সিদ্ধান্তের আগেই আদালত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী এক মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রচেষ্টা কেন অবৈধ হবে না—সে মর্মে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে রুলনিশি জারি হয়েছে। উল্লেখ্য, গভর্নিংবডির আগের সিদ্ধান্তমতেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চাকরির মেয়াদ আগামী বছরের পাঁচ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা তার প্রতি সমর্থনের কথা গভর্নিংবডির কাছে লিখিতভাবেও জানিয়েছেন। এসব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গভর্নিংবডি প্রবীণ ও জনপ্রিয় এই শিক্ষককে চাকরির শেষ সময়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা করে নিজেদেরই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জানা গেছে, সভাপতিসহ গভর্নিংবডির সদস্যদের ভর্তি বাণিজ্যে বাদ সাধার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সুপারিশে পাঁচ শতাধিক ছাত্রী ভর্তির পর আরও তালিকা আসতে থাকে। কিন্তু এদের সবাইকে ভর্তি করা সম্ভব না হওয়াতেই তাকে বিপদে পড়তে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। চাপের কাছে নতিস্বীকার করেও নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে এখন তাকে আত্মগ্লানিতে ভুগতে হচ্ছে। এখানে ছাত্রীপ্রতি কয়েক লাখ টাকা নেয়ার কথা কোনো গোপন বিষয় নয়। শুধু আর্থিক দুর্নীতিই নয়, বর্তমান গভর্নিংবডি প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া গভর্নিংবডির সভাপতির স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠানের ধানমন্ডি শাখায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া, ৪৫০ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৩০ জনকে এমপিওর সুবিধা দেয়া এবং সম্প্রতি প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগেও বাণিজ্যের কথা জানা গেছে। অথচ এই গভর্নিংবডিতে এমন সদস্যও রয়েছেন, যারা নিজেরাই অবৈধভাবে এই পদ আঁকড়ে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দেড় বছর যেতে না যেতেই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও মহামারীর মতো দুর্নীতি-অনিয়মের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এসব নিয়ে দেশজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস, খুনোখুনি, হামলা-মামলার ঘটনায় কেবল দেশের বর্তমান নিয়েই শুধু নয়, ভবিষ্যত্ নিয়েও মানুষ হতাশ না হয়ে পারেনি। ছাত্রলীগের বেপরোয়া অবস্থার রাশ টেনে ধরতে সরকারের দৃশ্যমান প্রচেষ্টায় ফল না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, অনেক লেখালেখি হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবাধ দুর্নীতি, দলীয়করণে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মহাজোটের শরিক দলগুলোর লোকজনও কীভাবে পাল্লা দিতে শুরু করেছে, সেটাও আর গোপন থাকছে না। কথিত বামপন্থীরাও যে এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। শিক্ষামন্ত্রী কি এর কোনো সমাধান দিতে পারবেন? আমরা অপেক্ষায় রইলাম।

No comments

Powered by Blogger.