এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী- একটি সমীক্ষা by সামসুল ওয়ারেস

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। মাসজুড়েই চলছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত ১৫তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী। প্রথম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে, একাডেমীর তৎকালীন চারুকলা বিভাগের পরিচালক শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের দর্শনে ও সহকারী পরিচালক সুবির চৌধুরীর পরিকল্পনায়।
তখন থেকে গত ৩২ বছরে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের শিল্পী, শিল্পরসিক ও জনসাধারণকে ক্রমান্বয়ে ১৫টি প্রদর্শনী উপহার দিয়েছে শিল্পকলা একাডেমী। কাজটি সহজ ছিল না। তাই একাডেমী যথার্থই প্রশংসার দাবি রাখে।
১৯৮১ সালে ১৪টি এশীয় দেশ অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে প্রয়াত বাংলাদেশের শিল্পী কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, শফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া ও ভারতের মকবুল ফিদা হুসেন অংশ নিয়েছিলেন। শুরু থেকেই এ প্রদর্শনী বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে অভূতপূর্ব আনন্দ, অনুপ্রেরণা ও জাগরণ সৃষ্টি করে। ১৯৯৭ সাল থেকে এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে আফ্রিকা ও প্যাসিফিক অঞ্চলের শিল্পীরাও যোগ দিতে শুরু করেন। দশম দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে ২০০১ সালে মোট ৪২টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এবার ৩৪টি দেশ। ইতিপূর্বে শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘরসহ একাধিক ভবনে এ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবারই প্রথম একাডেমীর নবনির্মিত নিজস্ব ভবনের তিনটি তলা নিয়ে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এবারে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে চিত্রকলা, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, স্থাপনা ও ভিডিওশিল্প। স্থাপনা ও ভিডিওশিল্পের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। দুজন বাংলাদেশি ও তিনজন বিদেশি শিল্পবিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিচারকমণ্ডলীর রায়ে তিনটি গ্রান্ড প্রাইজ ও ছয়টি সম্মানসূচক পুরস্কার ইতিমধ্যেই নির্বাচিত শিল্পীদের মধ্যে প্রদান করা হয়েছে। গ্রান্ড প্রাইজ তিনটি পেয়েছেন প্যালেস্টাইনের বাশার আল হুব, জাপানের মেইরো কইজুমি ও বাংলাদশের কাজী সালেহউদ্দীন আহমেদ।
এবারের ১৫তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সঙ্গে বরাবরের মতো আয়োজিত হয় শুরুতেই দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনার। সেমিনারে দেশি-বিদেশি অনেক শিল্পী ও শিল্প-সমালোচক অংশ নেন। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘ক্রস পলিনেশন ও আঞ্চলিক শিল্পকলা’।
এবারের প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের হূদয়ে অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা, যুদ্ধবিরোধী চেতনা, ধর্মীয় অনুভূতি ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা, আধুনিক নগরজীবনের যান্ত্রিকতা, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক বস্তু, আত্ম-জিজ্ঞাসা, মানুষ, বৃক্ষ, স্মৃতি, ঐতিহ্য, নিসর্গ ইত্যাদি।
ইউরোপীয় শিল্পকলার স্বরূপ ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত ইতিহাস যেমনটি আছে, তেমন করে এশীয় শিল্পকলার কোনো সন্নিবদ্ধ ইতিহাস নেই। এশীয় শিল্পকলা আন্দোলন বলে কিছু নেই, যেমনটি আছে ইউরোপে। এশীয় দেশগুলো আলাদাভাবে শিল্পচর্চা করে ভিন্ন ভিন্ন সমৃদ্ধ ইতিহাস রচনা করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায় এবং শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ও ভাবধারায় আধুনিক শিল্পকলার জন্ম হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে এশীয় শিল্পীরা ইউরোপসহ পশ্চিমের আধুনিক শিল্পকলার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে এবং প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। এশীয় শিল্পীরা পশ্চিমের আধুনিক ধারা আত্মস্থ করে তাঁদের সৃজনশীল ক্ষমতার কারণে এশীয় প্রেক্ষাপটে নিজস্ব শিল্প রচনা করতে সক্ষম হন। এ ব্যাপারে জাপান, কোরিয়া, চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড এগিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এ কারণেই আফগানিস্তানের কাজে প্রথাগতভাবে একদল অশ্বারোহী মানুষকে দেখা যায়। যদিও অনেক মুসলিম শিল্পী ক্যালিগ্রাফি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তথাপি তাঁদের কাজে প্যাটার্নের প্রভাব রয়ে গেছে; যেমনটি বাহরাইনের কাজে দেখা যায়। তবে ইরান যথেষ্ট বলিষ্ঠ। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শিল্পীই বর্তমানে মানুষের ফিগার আঁকছেন (যদিও অস্পষ্ট বা বিকৃত) এবং তাঁদের নিজস্ব বাস্তবতার কথা বলছেন। জাপান ও কোরিয়ার শিল্পকর্মে নগর সভ্যতার কঠোর সমালোচনা থাকে। এসব কাজের ফিনিশ অত্যন্ত নিখুঁত।
মঙ্গোলিয়ার শিল্পকর্মে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব যাযাবর চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ আছে। রাশিয়ার কাজে সোভিয়েত প্রভাব প্রত্যক্ষ। প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভারসাম্য নিয়ে শিল্পীরা চিন্তিত। সিঙ্গাপুরের শিল্পকর্মে নাগরিক সভ্যতায় যান্ত্রিকতা, নানা ধরনের জ্যামিতিক বিন্যাস ধরা পড়ে। থাইল্যান্ডের কাজ পরিচ্ছন্ন, দেশজ বাস্তবতার পরিমণ্ডলে আবর্তিত ও উন্নত। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শিল্পীরা বেশি করে অংশ নিয়েছেন। এসব দেশে শিল্পকলা যথেষ্ট পরিপক্ব ও সমকালীন বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। শ্রীলঙ্কার কাজে আত্মানুসন্ধানের তাগিদ স্পষ্ট। বাংলাদেশের কাজ সমকালীন ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে বাস্তবতা ও জটিলতা আশ্রয়ী। ভারত অংশ নিয়েছে ৪৫টি শিল্পকর্ম দিয়ে। বাংলাদেশের ১৩৮টি শিল্পর্কমের পরই ভারতের স্থান। ভারতের কাজ টেকনিকের দিক থেকে অনেক উন্নত ও বৈচিত্র্যময়। ভারতীয় শিল্পকলা সমাজবিদ্ধ ও নিজস্ব ধারা নির্মাণে নানা ধরনের গবেষণা ও উদ্ভাবনা লব্ধ। নেপালের নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা প্রথাগত ধর্মীয় প্রতীকী অবস্থান থেকে সরে ক্রমে বর্তমানের বাস্তবতার নিরীক্ষায় সংবেদনশীল শিল্প রচনায় ও উদ্ভাবনায় ব্যস্ত। ভুটান ধীরগতিতে আধুনিকতার পথে চলছে। প্রথাগত বৌদ্ধধর্মীয় প্রশান্তি তাঁদের কাজে বিরাজমান।
এশীয় বিয়েনালের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পীরা এশীয় দেশগুলোর সমকালীন শিল্পীদের মানসিকতা, মনন ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুধু চিন্তার রাজ্যে বিচরণ করেন না বরং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন; এটা অবশ্যই সুস্থ প্রক্রিয়া। এশীয় শিল্প কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ও সামগ্রিক প্রয়াসেই একান্ত এশীয় চারুকলা সৃষ্টি সম্ভব, যা হবে আঙ্গিকে, বিষয়বস্তুতে ও অভিব্যক্তিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অথচ পশ্চিমের শিল্পধারার সমান্তরাল। এটাই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.