দেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কি সেবা দিচ্ছে তারা?- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক কাজকর্ম নিয়ে প্রথম আলোয় ১২ ডিসেম্বর থেকে ছয় পর্বে যে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অদক্ষতা ও পরিকল্পনাহীনতা প্রকটভাবে উঠে এসেছে।
১১ বছর আগে এই মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত অর্থবছরে যেসব মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে ছিল, তার সামনের সারিতে ছিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।
স্বাধীনতাস্তম্ভ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল মন্ত্রণালয় ভূমিষ্ঠ হওয়ারও অনেক আগে, ১৯৯৭ সালে। ইতিমধ্যে চার-চারটি সরকার এলেও অদ্যাবধি কাজের সিংহভাগই রয়ে গেছে অবাস্তবায়িত। এর সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরাও সরে দাঁড়িয়েছেন মন্ত্রীর অসহযোগিতার কারণে। ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয় বলেই সাবেক জোট সরকার স্বাধীনতাস্তম্ভের কাজ আটকে রেখেছিল। কিন্তু মহাজোট ক্ষমতায় আসার চার বছর পরও প্রকল্পের কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া খুবই দুঃখজনক। একইভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ৩৫ কোটি টাকায় জোড়াতালি দিয়ে শেষ করার পর এখন বলা হচ্ছে, প্রকল্পটি ঠিকঠাক করতে আরও ৮০ কোটি টাকা দরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে না পারা। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও দলবাজি চলছে এবং ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা একশ্রেণীর মতলববাজ মুক্তিযোদ্ধা সেজে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিতে তৎপর। ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার দুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও সহায়তা দেওয়ার জন্য যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিল, তা এখন প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। সে সময়ে এই ট্রাস্টের অধীনে শিল্পকারখানাসহ ৩২টি প্রতিষ্ঠান ন্যস্ত করা হলেও প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান ঢিমেতেতালায় চালু আছে। বাকিগুলো হয় বিক্রি হয়ে গেছে, না হয় লোকসানের দায়ে বন্ধ। বেহাত হয়ে গেছে ট্রাস্টের মালিকানাধীন জমি ও অন্যান্য সম্পদ।
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে যে দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা, অব্যবস্থা ও অদক্ষতা জেঁকে বসেছে, তা থেকে মুক্তিযুদ্ধের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোও মুক্ত নয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি মানুষের আবেগ জড়িত। সেই আবেগকে পুঁজি করে যাঁরা জনগণের অর্থের অপচয় করছেন, যাঁরা ব্যক্তিগত ফায়দা লুটছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রথম আলোর ছয় পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি যদি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভাঙাতে না পারে, বুঝতে হবে, তাঁরা জেগে জেগেই ঘুমাচ্ছেন।
আদালতের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অনেকটাই রোধ করা গেছে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়েও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা আছে। একাত্তরের বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এত গড়িমসি কেন? দেশ ও মুক্তিযেদ্ধাদের স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কী করছে—জনগণের এ প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.