শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের মুক্তি-অর্থ লেনদেন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করতে চাপে গোয়েন্দারা by রেজোয়ান বিশ্বাস

শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসের মুক্তির ঘটনার নেপথ্য কুশীলবরা নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদপ্তরের যোগসাজশ এবং ওপর মহলের অর্থ লেনদেনের কাহিনী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় চলছে তোলপাড়।
বিকাশের মুক্তির নেপথ্য আয়োজন এবং অর্থ লেনদেন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করতে গোয়েন্দাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।
সূত্র মতে, বিকাশের বর্তমান অবস্থান ও তার সহযোগীদের বিষয়ে গোয়েন্দারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেও বিশেষ মহলের চাপে তাঁরা কিছু করতে পারছেন না। গোয়েন্দাদের ওপর কঠোর চাপ সৃষ্টি করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ নিয়ে পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতবিরোধ চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারা অধিদপ্তর ও পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকাশের মুক্তির বিষয়টি তাঁদের নাড়া দেয়। এ ধরনের ভয়ংকর সন্ত্রাসী মুক্তি পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। গ্রেপ্তার না হওয়া অনেক তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনো নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। তাদের সামাল দিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিকাশের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে গোয়েন্দা পুলিশ বর্তমান সরকারের সময়ে শীর্ষ জঙ্গি ও বড় মাপের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বিকাশের মুক্তির ঘটনায় বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের বিষয় নিয়ে পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক। এ ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন না করায় তাঁরাও বিস্মিত। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজ উদ্যোগে ঘটনার ছায়া-তদন্ত করছে। বিকাশের মুক্তির নেপথ্যে কারা, মুক্তির আগে কাদের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হয়- এসব বিষয়সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে বিকাশ মুক্তি পাওয়ার আগে কাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে তা জানা গেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছের কিছু লোক এবং কিছু ব্যবসায়ী নিজদের স্বার্থে বিকাশকে মুক্ত করেন বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কারা অধিদপ্তর ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা বিকাশকে মুক্তি পেতে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সম্পর্কে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। সময়মতো এসব তথ্য প্রকাশ করা হবে।
র‌্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বিকাশের মুক্তির সব আয়োজন হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। আয়োজনকারীরা পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে বিকাশকে মুক্ত করেছে। মুক্তির খবরটি পরোপুরি গোপন রাখার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কাশিমপুর কারাগার থেকেই বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। জামিন পাওয়ার পর ভয়ংকর অপরাধীদের আবার গ্রেপ্তারের আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও কৌশলগত কারণেই সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাশিমপুর কারাগারের কায়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বিকাশের মুক্তিপ্রক্রিয়ার সব কিছু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। এতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীর পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এক ভাগ্নে এবং মন্ত্রণালয়ের আরো অনেকে জড়িত। বিকাশ মুক্তি পাওয়ার এক সপ্তাহ আগে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পেঁৗছে। এরপর ওই টাকা অনেকের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি গোপন রাখতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা কারাগারে গিয়ে এবং ফোনে চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। এ কারণেই কারাগার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর বেরিয়ে গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার দৃশ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বিকাশের মুক্তির খবর আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেন জানানো হয়নি- এ প্রশ্নের জবাবে কাশিমপুর কারাগারের জেলার সুভাষ কুমার ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকাশকে আদালতের নির্দেশনা মেনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তির পর বিকাশকে গাড়িতে করে কারাগারের সমানে থেকে কারা নিয়ে যায় তা তাঁর জানা নেই। করাগারের ভেতরে সিসি ক্যামেরা থাকলেও বাইরের দৃশ্য ধারণ করা হয় না।
দেশেই আছে বিকাশ, নজরদারি চলছে : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত শুক্রবার কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গুলশানসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনে বিকাশের সঙ্গে অনেককে দেখেছেন গোয়েন্দারা। গভীর রাত পর্যন্ত তারা আড্ডা দিয়েছে। তার গতিবিধির ওপর সব সময় নজর রাখা হচ্ছে।
র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকাশকে গ্রেপ্তার করতে তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। বিকাশ এখনো দেশেই আছে বলে তাঁর কাছে তথ্য থাকার কথা জানান তিনি।
শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ ১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার হয়। এরপর গত ১৫ বছর সে কারাগারে ছিল। ২০০৯ সালে সব মামলায় জামিন পেলেও ক্রসফায়ারের ভয়ে সে কারাগার থেকে বের হয়নি। ওই সময় পিচ্চি হান্নানসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়।

No comments

Powered by Blogger.