ঐতিহ্য ও পরিবর্তন by সিলভিয়া নাজনীন

ধ্যানমগ্ন সৃষ্টিময়তায় আবর্তিত শিল্পভাষা বাঙালির শ্যামল সহোদর। ঐতিহ্য-স্বাদেশিকতা-আধুনিকতা বাংলার শিল্প-চেতনাকে যুগে যুগে পরিবর্তিত ও বিস্তৃত করেছে; করেছে আরও রসঘন ও নান্দনিক। অভিব্যক্তির বিশুদ্ধতায় শিল্পীদের মনোভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বৃহৎ বঙ্গ এবং ভারতীয় চিত্রকলার সুদীর্ঘ ইতিহাসের পরতে পরতে রহস্যময় রং-রেখার অবয়ব ভেঙে মানবিক বাস্তবতাই স্বাতন্ত্র্য তৈরি করেছে। পাশ্চাত্য প্রথায় শিল্পের বহির্গঠন কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠেনি, এখানে বরং গভীর অন্তর্দৃষ্টি তথা সমকালীন ভাষার ‘কনসেপচুয়াল আর্ট’ ছিল শুরু থেকেই। ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-সামাজিক সাদৃশ্য সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ও কলকাতা ধীরে ধীরে নিজেদের আলাদা সত্তায় থিতু হচ্ছে। বর্তমান কলকাতার শিল্পচর্চার গতিপ্রবাহ দেখার সুযোগ এ দেশের শিল্পানুরাগীদের খুব বেশি হয় না। তবে কখনো কখনো শিল্পী ও আয়োজকদের সমন্বয় হলেই ঢাকার শিল্প-দর্শক এ ধরনের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী উপভোগ করতে সমর্থ হন।
সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সেন্টারে শুরু হয়েছে কলকাতার শিল্পী কাজী অনির্বাণের ‘শিরোনামহীন’ শীর্ষক একক চিত্রকলা প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পী অনির্বাণ ‘দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে প্রদর্শনী করা এবং নতুন কিছু কাজ দেখানো, সব মিলিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত’; শিল্পী অনির্বাণ খুব অপরিচিত নন এ দেশের শিল্পভুবনে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্র। তিনি বলেন, ‘এ প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম মানুষকে নস্টালজিক করে তুলবে। আমার ছবি আঁকার মাধ্যম পুরোনো, স্টাইলও হতে পারে পুরোনো কিন্তু বিষয়ের উপস্থাপন প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক।’ শিল্পের সামাজিক দায়কে উপেক্ষা না করে মানবতাবাদী, জনসচেতনতামূলক ও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে অনেক মানবলগ্ন শিল্পীর কাজে। কাজী অনির্বাণ সেই জেনেটিক উত্তরাধিকার পুরোমাত্রায় বহন করে চলেছেন তাঁর চিত্রকলায়। ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে নিজের বোধকে সম্প্রসারিত করা, শিল্পচিন্তার অনুধ্যান নতুনভাবে উপস্থাপনের দক্ষতায় দৃষ্টিনন্দিত হয়ে উঠেছে শিল্পী অনির্বাণের এই প্রদর্শনী। তাঁর শিল্পকর্মে নারীদের সংগ্রাম, উজ্জ্বল-বর্ণিল জীবনগাথা অভিব্যক্ত হয়েছে নানাবিধ আঙ্গিকে। ‘আমাদের সমাজ এখনো যতখানি প্রগ্রেসিভ, তবু মেয়েদের অনেক আধুনিক আচরণকেই সহজভাবে মেনে নিতে পারে না, তাই আমার একটি চিত্রপটে বিষয়টি স্যাটায়ারের মাধ্যমে তুলে ধরেছি।’ এমন কপট বিষয়াবলির রয়েছে তীক্ষ সমালোচনা। তিনি ভিন্ন টাইপোগ্রাফিতে চিত্রতলে লিখেছেন ‘আমরা পরনিন্দা করি না।’ এই বক্তব্য চিত্রপটে ব্যবহার করেছেন বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই সমাজব্যবস্থার স্থূল মানসিকতাকে আরও একবার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন শিল্পী অনির্বাণ।
এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে বিভিন্ন মাধ্যমের উপস্থিতি লক্ষণীয়। চিত্রপটে রং-রেখার সঙ্গে গ্রাফিকস, টাইপোগ্রাফি, চলতি কথার সমন্বয় দেখা যায়। স্মৃতিপটের ধূসর কলকাতাকে রিভাইভ-রিকালেক্ট করার প্রচেষ্টা রয়েছে এ প্রদর্শনীতে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের কলকাতার রাস্তার পাশের হোল্ডিং-বিলবোর্ড-বিজ্ঞাপন-সিনেমার পোস্টার থেকে বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে অনির্বাণ সৃষ্টি করেছেন নতুন ধারায় তাঁর শিল্পকর্ম। তিনি মূলত এই প্রদর্শনীতে কাগজকে চিত্রতল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সলভেন্ট ইঙ্ক, এয়ার ব্রাশ, অ্যাক্রেলিক আর আধুনিক প্রযুক্তিকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন চিত্রশৈলীর শৈল্পিক দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন।
পারিবারিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা একজন শিল্পী সমাজ-মানুষের সঙ্গে গভীর মমতায় একাত্ম বোধ করবেন, সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। তবে অনির্বাণ বলেন, ‘আমার সব সময় ছবি আঁকতে ভালো লাগে না। আর সবই যে সিরিয়াস শিল্প-ভাবনাসমৃদ্ধ ছবি, তা নয়; আমার নিজের ভালো লাগা আর মনের তাগিদ থেকেই ছবি আঁকি, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’ অথচ শিল্পীর স্টুডিও ভিন্ন কথা বলে! একজন শিল্পমগ্ন মানুষের নিজের মনের খোরাক মেটানোর জন্য ব্যতিব্যস্ততা নয়, বরং দেশ-কাল-মানুষ-সমাজ আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর্কাইভ সৃষ্টির চেষ্টা দেখা যায় তাঁর প্রতিটি সৃজন পরিকল্পনায়।
একজন সচেতন শিল্পীকে চেনা যায় তাঁর ভাবনার বলয় দেখেই। কাজী অনির্বাণ নিজের ঐকান্তিক আগ্রহে সমৃদ্ধ করে চলেছেন শিল্পভুবনকে; হয়তো নিজের অজান্তেই। তিনি পুরোনো পটচিত্র-পুঁথিচিত্র-বটতলার চিত্রমালা, এক শ বছরের হারিয়ে যাওয়া সিনেমার পোস্টার সংরক্ষণের নানা শৈল্পিক উদ্যোগ নিয়ে থাকেন একান্ত ব্যক্তিগত তাগিদে। দুর্লভ ছবি নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর একটি বই প্রকাশ করেছেন তিনি।
কপটতা সমাজকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আততায়ীর মতো ঘাপটি মেরে আছে; স্বাভাবিক স্বার্থহীন বেঁচে থাকা এ সময়ের মানুষের কাছে কল্পনাবিলাস মনে হয়। মহৎ শিল্প মানুষকে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে প্রভাবিত করে; কাজী অনির্বাণ আমাদের সেই আবেগের-বিদ্রোহের-যুক্তিহীনতার নান্দনিক সংস্করণ। হতাশা আর দুঃসময়ে কিছু মানুষ আবারও নতুন স্বপ্নকে উসকে দিতে পারে। শিল্পী অনির্বাণ হতে পারেন তাঁদেরই কোনো একজন। ঐতিহ্য-বৈভব-বৈচিত্র্য আর পরিবর্তনকে পুনর্জাগরণের চেষ্টা এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য।
প্রদর্শনী চলবে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.