মংলা বন্দরের উন্নয়নে পদক্ষেপ জরুরি by ইফতেখার আহমেদ টিপু

চরম উপেক্ষার শিকারে পরিণত হয়েছে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা। এ সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও নেই কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ। বছরের পর বছর চলা অব্যবস্থাপনার সাক্ষাৎ ফলাফল হিসেবে মুখ থুবড়ে পড়েছে সম্ভাবনাময় এ বন্দর।
শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়িত্বহীন আচরণও এ দুরবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। পাকিস্তান আমলেও মংলা ছিল অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। স্বাধীনতার পরও পাটনির্ভর রপ্তানি বাণিজ্য এ বন্দরের ওপর নির্ভরশীল ছিল। চাল, গম, সিমেন্ট আমদানিতেও ব্যবহৃত হতো এ বন্দর। পাটশিল্প রুগ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মংলা বন্দরও রুগ্ণ অবস্থার শিকার হয়েছে। খাদ্য ও সিমেন্ট আমদানি শূন্যে চলে আসায় এর প্রতিক্রিয়াও পড়েছে বন্দরের অস্তিত্বে।
স্বাধীনতার পর থেকেই মংলা বন্দর ছিল উপেক্ষিত। এরই মধ্যে অনেক সময় বয়ে গেছে। আমাদের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে; পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও এ বন্দর ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি করতে চাইছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের পণ্য পরিবহন, হোটেল ব্যবসাসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলো উপকৃত হতে পারে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি হতে পারে সমৃদ্ধ।
নেপাল ও ভুটানের নৌপথ না থাকায় মংলা বন্দরের মাধ্যমে এ দুটি দেশ ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভিন্নভাবে উপকৃত হতে পারে। সেখান থেকে ফি আদায়ের সম্ভাবনাও কম উজ্জ্বল নয়। এ বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গেও সড়ক ও রেলপথে পণ্য ও কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ রয়েছে আমাদের। চট্টগ্রামের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মংলার দূরত্ব কম হওয়ায় সময় ও খরচ কম পড়বে। বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণও বাড়বে বহুলাংশে। প্রাণ ফিরে আসবে মংলা বন্দরের। এতে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নসহ সেখানকার অধিবাসীদের কর্মসংস্থানেরও ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেভাবে হোক, পদ্মা নদীর ওপর কাঙ্ক্ষিত সেতুটি নির্মাণ করতে হবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে মূল ধারার অর্থনীতির সম্পৃক্ততা বাড়বে। শুধু তা-ই নয়, মংলা বন্দরটিও হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু শুধু দেশের অর্থনীতিতেই অবদান রাখবে না, আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী নাব্যতা সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা মংলা বন্দরের বড় সমস্যা। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ড্রেজ না করা এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারণ করে পদক্ষেপ না নেওয়ায় বন্দরের রুট ও পুরো নৌ-চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ রুট হয়ে উঠছে এটি। অথচ এর নাব্যতা রক্ষায় সুদূরপ্রসারী কর্মোদ্যোগ নেই। মাঝেমধ্যে দায়সারাগোছের ড্রেজিংয়ে এর নাব্যতা রক্ষার চেষ্টা এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে।
মংলা বন্দরের সঙ্গিন অবস্থার জন্য অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম, শ্রমিক অসন্তোষ, বিগত সরকারগুলোর উদাসীনতা ও অদূরদর্শিতাকে দায়ী করা হয়। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বন্দরটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মংলা বন্দরকে আরো গতিশীল করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। মংলা বন্দরে যাওয়ার একমাত্র সড়কটিও বেহাল।
স্বাধীনতার পর কোনো সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ওই এলাকার অর্থনীতি। বন্দরের দুরবস্থার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের যথেচ্ছতাও অনেকাংশে দায়ী। বর্তমানে এ বন্দরের পাঁচটি জেটির চারটিই অচল। বন্দরের ধারণক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ বর্তমানে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মংলা বন্দরের অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়েও নিরাপদ এলাকায়। গত ১০০ বছরে মংলা বন্দর কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়নি। আশার কথা, বর্তমান সরকার মংলা বন্দরের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপের সুফল হিসেবে দেশের দ্বিতীয় এই সমুদ্রবন্দর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে এতেই সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। মংলা বন্দরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এটিকে ব্যস্ত বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। মংলাকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নের কথাও ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.

No comments

Powered by Blogger.