কালের কণ্ঠ অনুসন্ধান-এসআইয়ের মৃত্যুতে ওসির হাত! by জয়নাল আবেদীন

পুলিশ কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়ার দীর্ঘ ৩০ বছরের পেশাজীবনে সততা, মেধা, কর্মঠতা ও সুকৌশলী গুণের কারণে ঈর্ষণীয় পুরস্কারের পাশাপাশি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পিপিএম ও আইজিপিএম পদবি। আর এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তার জীবনের মর্মান্তিক পরিণতি ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় উপপরিদর্শক (এসআই) পদে কর্মরত অবস্থায় গত ১৩ ডিসেম্বর থানা ক্যাম্পাসেই এক রহস্যময় বিস্ফোরণে আহত হয়ে তিনি মারা যান। তিন দিন পর মৃত্যুর আগে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করতে করতে তিনি বলেছেন, মালখানার মালামাল নিয়ে ওই থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বেপারীর সঙ্গে তাঁর ঝামেলা চলছিল। রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুই যুবক তাঁকে লক্ষ্য করে বোমাজাতীয় কিছু একটা ছুড়ে মারলে বিস্ফোরণ ঘটে এবং তাঁর সারা শরীর ঝলসে যায়।
এসআই শাহজাহানের মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা উল্লেখ করে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করা হলেও কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে এ বিস্ফোরণের নেপথ্যে পাওয়া গেছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের গন্ধ। সরেজমিন বন্দর থানা ঘুরে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং সার্বিক বিষয়ে পুলিশ, সিআইডি, বোমা বিশেষজ্ঞ ও রসায়নবিজ্ঞানের বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শাহজাহানের মৃত্যু কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, মূলত সততার কারণেই অসাধু মহলের কোপানলে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর পরিবারেরও দাবি, শাহজাহানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী লায়লা সাজু বাদী হয়ে বন্দর থানার ওসি, সেকেন্ড অফিসার ও অজ্ঞাতপরিচয় দুজনকে আসামি করে আদালতে হত্যা মামলাও দায়ের করেছেন। কর্মজীবনে দেশের অসংখ্য থানায় কাজ করেছেন শাহজাহান। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় যোগ দেন তিনি। গত ১৩ ডিসেম্বর হরতালের দায়িত্ব পালন শেষে থানায় ফিরে রাত সাড়ে ৯টায় তিনি রহস্যময় বিস্ফোরণের শিকার হন। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ১৭ ডিসেম্বর ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাত সাড়ে ৯টায় বিস্ফোরণের আগুনে শরীরের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ দগ্ধ হয় শাহজাহানের। বাঁচার আকুতি জানিয়ে তিনি থানা ক্যাম্পাসে লুটিয়ে ছটফট করছিলেন। অথচ তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। এমন মর্মান্তিক ঘটনার খবরও দেওয়া হয়নি তাঁর পরিবারকে। একটি প্রয়োজনে শাহজাহানের স্ত্রী লায়লা রাত ১১টা ৫০ মিনিটে মোবাইলে ফোন করলে ঘটনা জানতে পারেন। বিস্ফোরণের খবর পরিবার জেনে গেলে পুলিশ শাহজাহানকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অথচ বন্দর থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা বিনয় কৃষ্ণ কর দাবি করেন, আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে করে শাহজাহানকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। থানার পরিদর্শক রকিব বলেন, কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ ভ্যান পরিবর্তন করে একটি মাইক্রোবাসে করে তাঁকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়া হয়। ওসি নূর মোহাম্মদ বেপারীও দাবি করেন, ঘটনার পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে সময় এক ঘণ্টাও লাগেনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, রাতের ওই সময়টায় ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেডিক্যালে যেতে সময় লাগার কথা সর্বোচ্চ সোয়া এক ঘণ্টা। সে হিসেবে রাত ১১টার আগেই হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে রোগী ভর্তির নিবন্ধন খাতায় দেখা গেছে, রাত ১টা ৫ মিনিটে শাহজাহানকে ভর্তি করা হয়।
১৩ ডিসেম্বর বিস্ফোরণের ঘটনার পর ওসি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ঘটনাস্থলে তিনি বারুদের গন্ধ পেয়েছেন। পরে শাহজাহান যখন মারা যান, তখন বোল পাল্টে ওসি বলেন, মদের দাহ্য পদার্থ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই রাতে এসআই শাহজাহান মদপান করছিলেন, পাশাপাশি পাতায় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে মদের বোতল আগুনে ছিটকে পড়লে বিস্ফোরণ ঘটে।
নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শাহজাহান সব সময়ই মদপান করত। এটা তার পুরনো অভ্যাস।' 'আপনার অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা থানার ভেতরে মদপান করে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেননি কেন'- প্রশ্ন করা হলে ওসি বলেন, 'আমি এ থানায় যোগ দিয়েছি গত ৩০ অক্টোবর। অল্প সময়ের মধ্যে সে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।' একপর্যায়ে নূর মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, 'বছরখানেক আগে মদপানের অভিযোগে সোনারগাঁ থানার ওসি শাহজাহানকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন।'
এ অভিযোগের সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হয় সোনারগাঁ থানার ওসি হারুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, শাহজাহান যখন কর্মরত ছিলেন, তখন এ থানার ওসি ছিলেন ইউনুস আলী। তিনি এখন ঢাকার উত্তরখান থানায় আছেন।
যোগাযোগ করা হলে বিস্ময় প্রকাশ করে ইউনুস আলী বলেন, 'শাহজাহানকে নিয়ে আমি গর্ব বোধ করি। পুলিশে এমন অফিসার খুব কমই আসে। শাহজাহান খুবই কর্মঠ, মেধাবী এবং কৌশলী অফিসার ছিলেন। যেকোনো তদন্ত খুব ভালো বুঝতেন। পেশাদারিত্বে তিনি শতভাগ নিজেকে উজাড় করে দিতেন।' ইউনুস আরো বলেন, 'আমরা একসঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁ থানায় চাকরি করেছি। কখনো তাঁকে মদপান করতে দেখিনি, এমন কথাও শুনিনি। শাহজাহান মরে গেছেন বলেই সাধুবাদ দিচ্ছি না, জীবিত থাকলেও বলতে দ্বিধা কারনি যে তিনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার ভিত্তিতেই তিনি বদলি হয়েছিলেন।'
বন্দর থানার ব্যারাকে শাহজাহানের সঙ্গে পাশাপাশি কক্ষে অবস্থানকারী এসআই লাল মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'মানুষ হিসেবে শাহজাহান খুবই ভদ্র ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে আমরা পাশাপাশি রুমে থাকি। আমি কখনো তাঁকে মদপান করতে বা মদ্যপ অবস্থায় দেখিনি।'
ভিডিওচিত্রে শাহজাহান : বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রায় ৭৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন শাহজাহান। এ সময় তিনি ঘটনার কারণ সম্পর্কে স্বজনদের অনেক কিছুই বলে গেছেন। তাঁর সেসব বক্তব্যের দুটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, পোড়া শরীরে ছটফট করছেন শাহজাহান। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'হরতালের দায়িত্ব পালন শেষে রাত ৯টার দিকে থানায় আসি। এরপর প্রয়োজনীয় কার্যাদি সেরে ব্যারাকে যাই। তারপর খাকি পোশাক পরিবর্তন করে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে আসি। ওই সময় আমার অ্যাজমার খুব সমস্যা ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গাছতলায় দাঁড়াই। বাইরের দিকে খুব অন্ধকার। হঠাৎ দেখি দুটি ছেলে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওদের পরনে প্যান্ট, গায়ে হাফ হাতা গেঞ্জি (টি-শার্ট)। আরো সামনে এলে জিজ্ঞেস করি, এই কেডা? কোনো উত্তর পাই না।
আবারও জিজ্ঞেস করি- কী হইছে, কথা বলে না কেন? তোমরা ক্যাডা? জবাবে ওরা বলে, আমরা- আমরা। একজনের হাত দুটি পেছনের দিকে ছিল। পরে প্যান্টের পকেট থেকে বের করে কী যেন একটা ছুড়ে মারে। তখনই মনে হয়েছে- এটা বোমাজাতীয় কিছু একটা হবে। এরপর যখন আমার শরীরে আগুন ধরে যায়, আমি চিৎকার করে কম্পিউটার অপারেটরকে বলি, আলীম ভাই, আমারে বাঁচাও, তাড়াতাড়ি আসো। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারি না।'
আরেকটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়- ছেলে শুভ্র বাবাকে প্রশ্ন করেন, 'সেই রাতে কী হয়েছিল আব্বা?' জবাবে শাহজাহান বলেন, 'ওসি সাহেবের সঙ্গে ঝামেলা লাগছিল।' কী কারণে ঝামেলা- ছেলের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তারিখটা আমার মনে নাই। মালখানার কিছু মাল যাবে কোর্টে। আমি খবর পাই, বাবুর্চিকে দিয়ে মাল বের করানো হচ্ছে। বাইরে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমার মনে হয়েছে, অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু হতে যাচ্ছে। আমি তখন ওসিকে বলি- ওস্তাদ, অসৎ উপায়ে কোনো কাজকর্ম করতে পারবেন না। আমি থাকতে এটা করতে দিব না।'
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে শাহজাহান ছেলেকে বলেন, 'বাবা, আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে।' এরপর আর কথা বলতে পারেননি শাহজাহান।
এসব ভিডিওচিত্রের বাইরেও অনেক কথা বলেছেন শাহজাহান। স্ত্রী, ছেলে ও স্বজনদের তিনি বলেছেন, ওসি ও সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল তাঁর। তাঁরাই দুটি ছেলেকে দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর ওপর বিস্ফোরণ ঘটায়। দীর্ঘদিন ধরে অসৎ কাজে বাধা দেওয়ায় সেকেন্ড অফিসার বিনয় কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব লেগে যায়। গত অক্টোবরে নূর মোহাম্মদ ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তিনিও সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে হাত মেলান।
যে মালখানার মাল নিয়ে ঝামেলা চলছিল বলে জানিয়ে গেছেন শাহজাহান, সেই মালখানায় এখন কী মালামাল আছে- এর উত্তর মেলেনি। বন্দর থানার ওসি, পুলিশ পরিদর্শক, দ্বিতীয় কর্মকর্তা কেউই মুখ খুলতে রাজি হলেন না। মালখানায় ঢোকাও কোনোভাবে সম্ভব নয়। তবে ওসি বলেছেন, সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নেই। কারণ গত ১০ বছরেও এ থানায় বড় কোনো অভিযান হয়নি।
হত্যা মামলা- ওরা নৃশংস হত্যাকারী : এ ঘটনায় শাহজাহানের স্ত্রী লায়লা শাজু বাদী হয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে ওসি ও সেকেন্ড অফিসারকে 'সরকারি পোশাকে নৃশংস হত্যাকারী' উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তাঁদের নির্দেশেই অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তি শাহজাহানের ওপর উচ্চ দাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা নিক্ষেপ করে। এতে তাঁর শরীরের ৯০ ভাগ দগ্ধ হয়ে ঝলসে যায়। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর বড় ভাই ফরিদ আহাম্মেদ ও ছেলে শুভ্রর কাছে বলে গেছেন, হত্যার উদ্দেশ্যে ওসি ও সেকেন্ড অফিসার পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করেছেন। এমনকি গুরুতর আহত শাহজাহানকে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেননি। এসব অভিযোগ এনে বন্দর থানায় মামলা করতে চাইলেও থানা মামলা গ্রহণ করেনি।
ঢিলেঢালা তদন্ত : ১৩ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় বিস্ফোরণের ঘটনায় ওই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-৬৬৯) করা হয়। আহত শাহজাহান ১৭ ডিসেম্বর মারা গেলে জিডি পরিণত হয় অপমৃত্যুর মামলায় (নম্বর-৩৫)। এই মামলায় বাদী হন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীনুর রহমান। মামলাটি তদন্ত করছেন বন্দর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রকিব উজ জামান।
অন্যদিকে এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমান, বিশেষ শাখার পরিদর্শক আমজাদ হোসেন ও বন্দর থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বেপারীর নাম উল্লেখ করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন এসপি। পরে শাহজাহানের পরিবারের আপত্তির কারণে কমিটি থেকে ওসির নাম প্রত্যাহার করা হয়। সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম আজাদ খান।
তদন্ত কমিটির প্রধান সাজ্জাদুর রহমান শনিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্তকালে বারুদ বা বিস্ফোরকদ্রব্যের কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভাব্য কারণ হিসেবে 'অ্যালকোহল থেকেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে' উল্লেখ করে প্রতিবেদনটি গত ২০ ডিসেম্বর জমা দেওয়া হয়েছে।
তদন্তকালে শাহজাহানের পরিবারের কারো সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তাই তদন্ত একতরফা হয়েছে উল্লেখ করে শাহাজাহানের ছেলে শুভ্র কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্ত স্বচ্ছ হয়নি। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত কখনোই পুলিশ দিয়ে হবে না।'
এ ছাড়া অপমৃত্যুর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও শাহজাহানের পরিবারের কারো সঙ্গে আলোচনা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনিও শাহজাহানের ভিডিওচিত্র আমলে নেননি। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা রকিব উজ জামান বলেন, 'আমি পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত করছি না। আমি তদন্ত করছি অপমৃত্যু মামলার।'
তবে ঘটনাটি রহস্যজনক উল্লেখ করে এসপি নাজমুল বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এ ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু এটা কিভাবে ঘটেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। বিস্ফোরণ কিভাবে ঘটেছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কোনো সন্ত্রাসী কিংবা বাইরের কোনো চক্রের সম্পৃক্ততা আছে কি না তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা থেকে পরিদর্শক আরিফ ইফতেখারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল বন্দর থানায় যায়। তারা সেখান থেকে শাহজাহানের ব্যবহৃত চার টুকরা পোড়া কাপড়, গাছের পোড়া পাতা, স্যান্ডেল, ব্যারাক ভবনের পলেস্তারার টুকরা এবং শাহজাহানের থাকার কক্ষে টেবিলের ওপর থাকা আধাগ্লাস অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ উদ্ধার করেছে। সেগুলো মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা রকিব উজ জামান এখন পর্যন্ত অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তিনি এখনো সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও হাতে পাননি। তিনি বলেন, ঘটনার আলামত ঢাকার সেগুনবাগিচায় বিস্ফোরক পরিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন আসেনি। প্রতিবেদন দ্রুত পাওয়ার আবেদন জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার দিন শাহজাহানের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনের কললিস্ট সংগ্রহের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেটি হাতে পেলে কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে।
শাহজাহানের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন রাজধানীর শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মামুন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, শাহজাহানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝলসে গেছে। অজ্ঞাত বিস্ফোরণে এ অবস্থা হয়েছে বলে সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে বন্দর থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
সরেজমিন- আলামত নষ্টের বহু নজির : ঘটনার পর অনেকটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বন্দর থানায়। থানার ফটকে নেই কোনো গেট। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতেই ভেতর থেকে এক কর্মকর্তা এসে প্রশ্ন করেন, 'আপনি কে? কেন এসেছেন?'
পরে জানা গেল, ওই কর্মকর্তাই সেকেন্ড অফিসার বিনয় কৃষ্ণ কর। শাহজাহানের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে দেওয়া এজাহারে তিনি ২ নম্বর আসামি।
ওসির কক্ষের ১০ গজের মধ্যেই অবস্থিত ব্যারাক, কয়েক পা এগোলেই বরই (কুল) গাছতলা। সেই রাতে ওই স্থানেই ঘটেছিল বিস্ফোরণ। সেদিকে যেতে চাইলে বাধা দেন বিনয়। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তিনি সেখানে যেতে নিষেধাজ্ঞা আছে বলে জানান। পরে পরিদর্শক রকিবের অনুমতি নিয়ে সেখানে গিয়ে কিছু নমুনা দেখা গেল। একই গাছের অর্ধেক অংশের ডালপালা আর পাতা স্বাভাবিক থাকলেও অন্য অংশ পুড়ে লাল হয়ে আছে। ভূমি থেকে ওই পাতা প্রায় ১৫ ফুট উঁচু। আশপাশে ছোট ছোট কয়েকটি বরই গাছের পাতাও পোড়া।
জানা গেল, আমগাছ থেকে একটু দূরের একটি বরই গাছ ঘটনার পরই কেটে ফেলা হয়। আর ঘটনাস্থলে দেখা যায় নতুন বালির প্রলেপ। রকিব উজ জামান বলেন, থানায় গাছগাছালি বেড়ে যাওয়ায় কয়েক দিন ধরেই পরিষ্কার করার কাজ চলছিল। তাই গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা। তবে কোনো আলামত নষ্ট হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
থানার সামনের দোকানপাটের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ট্রান্সফরমার বিকল হলে যেমন বিকট শব্দ হয়, ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল বিস্ফোরণের শব্দ। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশে অবস্থানকারীরা ঘটনাস্থলের দিকে যেতে চাইলেও পুলিশ তখন বাধা দেয়।
শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে নারায়ণগঞ্জের ডালপট্টি ফায়ারঘাটের খেয়াঘাটের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সেদিনের বিস্ফোরণের কথা জানতে চাইলে সেখানকার অনেকেই বলেন, ওই রাতে বিকট আওয়াজ এখান থেকেও শোনা গিয়েছিল। মনে হয়েছে, কোথাও বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে।
জানা যায়, বিস্ফোরণের খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে ওয়্যারলেসে প্রচার করায় অপারেটর নুরুজ্জামানকে র্ভৎসনা করেন ওসি। তবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে নুরুজ্জামান বলেন, অনুমতি ছাড়া খবরটি কেন প্রচার করা হলো, তা জানতে চেয়েছেন ওসি।
অজ্ঞাতই রয়ে গেল সেই দুজন : মৃত্যুর আগে শাহজাহান দুটি ছেলের কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ বিষয়টি আমলেই নেয়নি তদন্তদল। অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের দাবি, থানার সঙ্গে কারো বৈরী সম্পর্ক নেই। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে শাহজাহানের ভাষ্য মতে এ দুটি ছেলে কেন থানার ভেতরে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালো? ঘটনার সময় ওসি, পুলিশ পরিদর্শক, দ্বিতীয় কর্মকর্তা এবং অন্য বেশির ভাগ কর্মকর্তাই নিজেদের আসনে অবস্থান করছিলেন। এত সরব উপস্থিতির মধ্যেও এমন একটি ঘটনা সন্দেহ বাড়াচ্ছে।
আগের কয়েক দিনের নানা উদাহরণ দিয়ে শাহজাহানের স্ত্রী লায়লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শাহজাহান প্রায়ই আমাকে ফোনে বিপদের কথা বলতেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তিনি বলতেন, ওসির সঙ্গে ঝামেলা চলছে। আমি বিপদে আছি, আমার সময় ভালো যাচ্ছে না। তবে কী কারণে ওসির সঙ্গে ঝামেলা, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বিস্ফোরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বলেননি।'
এ সময় ছেলে শুভ্র অভিযোগ করেন, 'বাবাকে খুন করাই ওদের উদ্দেশ্য ছিল। বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। ঘটনার সাড়ে তিন ঘণ্টা পর রাত দেড়টায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। দুর্ঘটনার খবরটি পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। এ ছাড়া বাবার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন ফেরত দেওয়া হয় দুই দিন পর। কিন্তু ১৩ ডিসেম্বরের সব কললিস্ট মুছে ফেলা হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়, পরিকল্পিতভাবে বাবাকে হত্যা করা হয়। তারা চেয়েছিল হাসপাতালে আনার আগেই বাবার মৃত্যু হোক। সে জন্য মুমূর্ষু অবস্থায়ও বাবাকে থানায় অযত্নে ফেলে রাখা হয়।'
ব্যবসায়ী সাগরের গা ঢাকা : থানা থেকে বের হলেই সামনে পড়ে একটি ছোট ডিপার্টমেন্ট স্টোর। ওই দোকানের মালিক স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাগর। তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শাহজাহানের। ওই রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দোকান ছেড়ে ছুটে যান সাগর। গিয়ে দেখেন শাহজাহানের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। তিনিই দোকান থেকে অনেক ডিম এনে ভেঙে শাহজাহানের প্রাথমিক শুশ্রূষার চেষ্টা করেন। পরে সাগর তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত তিনি সঙ্গেই ছিলেন।
সাগরের দোকানে গিয়ে দেখা হয় তাঁর বড় ভাই নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। নাসির জানান, কয়েক দিন ধরে সাগর দোকানে আসছেন না। সে জন্য তিনিই নিয়মিত দোকানে বসেন। সেখান থেকে সাগরের মোবাইলে ফোন করে দেখা করতে চাইলে সাগর তাঁর দোকানে আসতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কথা ইঙ্গিত করা হলে তিনি বলেন, 'আপনি পূর্ব দিকে আসতে থাকেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি।' আড়ালে গিয়ে কথা বলতে চাইলেও অনেক কথাই এড়িয়ে যান সাগর। তিনি বলেন, 'একটা সমস্যা আছে, সে কারণে দোকানের দিকে যাচ্ছি না।'
ধারণা করা হচ্ছে, সুসম্পর্ক থাকার কারণে সেই রাতে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শাহজাহান সাগরকে স্পর্শকাতর কোনো তথ্য বলে গেছেন। ওদিকে সাগর পুলিশের অপমৃত্যু মামলায় সাক্ষী। তাই সাগর এখন কিছুই ফাঁস করতে চাইছেন না। সাগরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সেই রাতের অনেক তথ্য মিলতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
শাহজাহানের পরিবারে অনিশ্চয়তা : অধ্যয়নরত এক ছেলে এবং দুই মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখছেন শাহজাহানের স্ত্রী লায়লা। ছেলে মোর্শেদ জাহান শুভ্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ, বড় মেয়ে ফাতেমা তুজ জোহরা এবার এইচএসসি পাস করেছেন এবং ছোট মেয়ে সানজিদা জাহান জয়া পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। এখন তাঁরা মিরপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন।
লায়লা বলেন, 'স্বামীর বেতনের সামান্য আয় দিয়ে কোনোমতে আমাদের সংসার চলে যেত। এখন আমাদের কী হবে?' তিনি আরো বলেন, হাসপাতালের বিছানায় যখন পোড়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তখনো শাহজাহান ছেলেমেয়েদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : বন্দর থানার বিস্ফোরণের ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করা হলে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শাহজাহানের হাতে যদি কোনো অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ থাকে এবং সেটি যদি নিচে আগুনে পড়ে, তাহলে বিকট শব্দে এত বেশি বিস্ফোরণ ঘটার কোনো সুযোগ নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল হাই কালের কণ্ঠকে বলেন, আগুনের মধ্যে মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় কোনো পদার্থ পড়লে আগুনের তীব্রতা বাড়তে পারে। কিন্তু বিকট শব্দ হওয়ার কথা নয়।
বোমা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (ক অঞ্চল) গোলাম আজাদ বলেন, ওই ঘটনায় বিকট শব্দ হওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। তবে সিআইডির বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত করলে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি দিলীপ কুমার মণ্ডল]
শাহজাহানের ভিডিও ভাষ্য

No comments

Powered by Blogger.