সঙ্গীতগুরু সোহরাব হোসেন তাঁর চলে যাওয়া শুধু একজন সঙ্গীতগুরুর বা শিল্পীর চলে যাওয়া নয়, একজন বিশিষ্ট বিদগ্ধ সুন্দর হৃদয়ের শ্রদ্ধেয় মানুষের চলে যাওয়া

চলে গেলেন সঙ্গীতগুরু সোহরাব হোসেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে কয়েকদিন আগে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর এক হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার চলে গেলেন সবকিছু ছেড়ে চিরকালের জন্য। সবাইকেই যেতে হবে। যেত হয়। এটাই নিয়ম।
কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মানুষ সমাজে থাকেন যাঁদের বয়স যতই হোক, যে বয়সেই তাঁদের চলে যেতে হোক না কেন, মনে হয় তাঁদের চলে যাওয়া যেন অকালেই চলে যাওয়া। এ ধরনের মানুষকে সমাজের প্রয়োজন। সমাজের স্বাথের্, মানুষের স্বার্থে তাঁদের থাকা প্রয়োজন। সোহরাব হোসেন চলে গেছেন ৯১ বছর বয়সে। তবু তাঁর চলে যাওয়া যেন অকালেই যাওয়া। তাঁদের মতো মানুষের চলে যাওয়া শুধু তাঁদের পরিবারের আপনজনদেরই ক্ষতি নয়, ক্ষতি সমাজের, ক্ষতি গোটা দেশের। সাহিত্য শিল্পকলা তথা সামগ্রিক ললিতকলার খ্যাতিমান যাঁরা, সমাজে তাঁরা নিজেরাই শুধু বাস করেন না, তাঁদের ঘিরে গড়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ। আনন্দের পরিবেশ। মানুষকে তাঁরা নিজেদের সৃষ্টির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করেন, প্রভাবিত করেন ফলে সমাজে গড়ে ওঠে একটা সুস্থ কাব্যিক সাহিত্যিক বা সঙ্গীতময় পরিবেশ। এই পরিবেশ মানুষের মনোজগতের উন্নয়ন তথা বিকাশের জন্য প্রয়োজন, সমাজে একটা সুস্থ মানবিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যও এটা প্রয়োজন। এসব মানুষের সাহচর্য এবং তাঁদের সান্নিধ্যে যাঁরা থাকেন তাঁরাও তাঁদেরই মতো আলোকিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজে অবস্থান করে নেন। শিল্পী-সাহিত্যিক সঙ্গীতজ্ঞরা তৈরি করে যান এই ধারাটি। এই ধারা বিকাশমান এবং এটি সম্প্রসারিত হতে থাকে ক্রমশ। সমাজের বিকাশ বা সামাজিক উন্নয়নের জন্যও এটা খুবই প্রয়োজন।
সোহরাব হোসেনের পরিচয় তিনি নজরুল সঙ্গীতের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পী। কিন্তু মূলত তিনি একজন সঙ্গীতগুরু। উচ্চাঙ্গ এবং নজরুল সঙ্গীতের সর্বজনশ্রদ্ধেয় গুরু এবং শিল্পী ছিলেন তিনি। দীর্ঘ তাঁর সঙ্গীতের জীবন। এই দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে বহু শিল্পীকে গড়ে তুলেছেন তিনি। আজকের অনেক খ্যাতিমান শিল্পী তাঁর ছাত্র। আজকের মানুষ তাঁর সঙ্গীতের ভক্ত। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। কবির সঙ্গীতের শুদ্ধতা রক্ষা, তাঁর সুরকে সঠিকভাবে রক্ষা এবং অন্যদের তাঁর প্রচারের ক্ষেত্রে এদেশে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সোহরাব হোসেন সেই প্রথম সারির মধ্যে বিশিষ্ট একজন শিল্পী। নজরুল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ভোলা যাবে না। অত্যন্ত প্রাণবন্ত,বন্ধুবৎসল, দিল খোলা মানুষ ছিলেন তিনি। শিল্পীসুলভ প্রাণের আবেগে সবাইকে তিনি সহজে আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর এই চলে যাওয়া শুধু একজন সঙ্গীতগুরুর বা শিল্পীর চলে যাওয়া নয়, তাঁর চলে যাওয়া একজন বিশিষ্ট বিদগ্ধ সুন্দর হৃদয়ের শ্রদ্ধেয় মানুষের চলে যাওয়া। তাঁর চলে যাওয়ায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ক্ষতি, গোটা সমাজের ক্ষতি।
শিল্পী সোহরাব হোসেনের চলে যাওয়ায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর পরিবারবর্গকে জানাই আন্তরিক সমবেদনা। শিল্পীর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.