উত্তরবঙ্গের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ by শাহীন রহমান

উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুল ও কলেজ ১৪৫ বছরের ঐতিহ্য ও গৌরবে মহীয়ান এক শিক্ষালয়। তৎকালীন উপমহাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ। রংপুর বিভাগের প্রথম অবৈতনিক বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
১৮৬৮ সালে কাশিমবাজার বাহারবন্দ পরগনার প্রজাদরদি, শিক্ষানুরাগী ও মহীয়সী নারী মহারানী কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়াই এই অবৈতনিক হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুদূর পল্লীতে এস্টেট পরিচালনার কাজ করতে গিয়ে এর রাজকর্মচারীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, তার মধ্যে স্কুল সংকট ছিল অন্যতম। তাই পশ্চাৎপদ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার এবং রাজকর্মচারীদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে তিনি এই স্কুল গড়ে তোলেন।
প্রায় ৫ একর জমির ওপর এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। মহারানী স্বর্ণময়ী স্কুল ছিল সেকালে উত্তরবঙ্গের একমাত্র স্কুল, যা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিজস্ব ভূমিতে স্থাপিত। বাহারবন্দ এস্টেট থেকে তখন স্কুলের খরচ বাবদ মাসে ৩৮৫ টাকা অনুদান প্রদান করা হতো। শুরুর দিকে মহারানীর বাহারবন্দ কাছারির নায়েব শ্যামাচরণ মহাশয়কে পালকিতে চড়ে মানুষের বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ করতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে গুটিকয়েক ছাত্র, যারা উচ্চ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতো তারা বিভিন্ন জমিদারের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজে যোগ দিত। ফলে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার মতো ছাত্র পাওয়া যেত না। আবার অজপাড়াগাঁ হওয়ায় প্রথম দিকে শিক্ষক সংকট ছিল প্রকট। কেননা, শিক্ষকতা করার মতো উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যেত না। স্কুল কর্তৃপক্ষকে তখন কলকাতায় হোটেলে থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন মারফত যোগ্য শিক্ষক সংগ্রহের কাজটি করতে হতো। সেই সব দুর্লভ ও সুযোগ্য শিক্ষক বড় বড় শহরের আরাম-আয়েশ ও সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে সুদূর পল্লীতে শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অনেকে স্কুলের মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে এখানেই আমৃত্যু থেকে গেছেন।
স্কুলের প্রথম হেডমাস্টার ছিলেন শ্রদ্ধেয় লক্ষ্মণ ভৌমিক। ১৮৭৩ সাল নাগাদ ছাত্রসংখ্যা অর্ধশ'তে উন্নীত হয়নি এবং তখন পর্যন্ত স্কুলটি সরকারি সাহায্য পায়নি। ১৪৫ বছর আগে রোপিত এ শিক্ষাতরুর বীজ ক্রমে ফুলে-ফলে শোভিত বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। আপন কীর্তির মহিমায় তার উজ্জ্বলতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৮৬৮ সালে কলকাতা কেন্দ্রে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এই স্কুল রংপুর জিলা স্কুলের সমসাময়িক হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সেই স্কুল বর্তমানে নানা দিকে বিকশিত হয়ে কলেজ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় কত শত খ্যাতিমান, কীর্তিময়, বরেণ্য, জ্ঞানী-গুণী ছাত্রের পদভারে কম্পিত হয়েছে এ স্কুল। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করা কত জানা-অজানা নামি-দামি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-রাজনীতিবিদ-খেলোয়াড়-পেশাজীবী-সমাজসেবী ছাত্রজীবনে মুখর করে রেখেছিলেন প্রিয় প্রাঙ্গণ। আজও যেন স্কুলের ক্লাসরুমে, করিডোরে, মাঠে সেই কোলাহলের অনুরণন ছড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের নাটকের দেবদূত সেলিম আল দীনের শৈশব কেটেছে এই স্কুলে, যা তার 'লেখক জীবনের জন্মভূমি'। ভারতের বিশিষ্ট সাহিত্যিক মনোজ বসু, রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও শহীদ বুদ্ধিজীবী বিজয় চন্দ্র মৈত্র (পাখি বাবু), ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ তারিণী কিশোর দে, অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নজির হোসেন খন্দকার, পরমাণুবিজ্ঞানী ড.ওয়াদুদ মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাহিত্যিক গোপাল ভৌমিক প্রমুখ কীর্তিমান ছাত্রের পদচারণায় মুখর ছিল এ প্রাঙ্গণ। এই স্কুলে শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে জীবন ধন্য করেছেন কবিশেখর কালিদাস রায়ের মতো কত জ্ঞানতাপস। তিনি মানুষের মন এতটাই জয় করেছিলেন যে, উলিপুর ত্যাগকালে ছাত্ররা গরুর গাড়ির পেছনে ২০ কিলেমিটার হেঁটে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে কুড়িগ্রামে ট্রেনে তুলে বিদায় জানিয়েছিল। এসব শিক্ষকের সানি্নধ্যের পরশপাথরে অগণন শিক্ষার্থীর জীবন হয়েছে স্বর্ণালি। স্বদেশ চেতনা, মানবতা, ন্যায়-নীতি, আদর্শবাদিতা, স্বাধিকারবোধ আমাদের মনে সঞ্চারিত হয়েছে এসব শিক্ষাগুরুর কৃপায়। তাই তো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনবিরোধী সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাতারে উজ্জ্বল উপস্থিতি এই স্কুলের ছাত্রদের। আর নানা সময়ে এই প্রগতিশীল ভূমিকার জন্য খেসারত দিতে হয়েছে স্কুলকে। ফলে গণবিরোধী বিভিন্ন সরকারের রোষানলে পড়েছে স্কুলটি। ভাবতে শিহরণ জাগে_ বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সশস্ত্র ধারার গোপন সংগঠন অনুশীলন দলের একটি স্থানীয় গুপ্ত শাখা গড়ে উঠেছিল গত শতাব্দীর বিশের দশকে এই স্কুলেরই ছাত্রদের উদ্যোগে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তারা। কারাবরণও করেছিলেন এই ছাত্রদের মধ্যে দু'জন বিপ্লবী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এ স্কুলের ছাত্রদের নাম। প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্কুলের ছাত্রদের ঈর্ষণীয় কৃতিত্ব আমাদের অনুপ্রাণিত করত। প্রায় দেড় শতাব্দী প্রাচীন এই স্কুলের নানা বয়স, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম-বর্ণের ছাত্ররা আজ জীবনযুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু তারা এখনও সেই স্কুলজীবনের মধুর স্মৃতি রোমন্থন করেন। জীবন-জীবিকার সংগ্রামে পরিশান্ত মনে যেন শান্তির চন্দন প্রলেপ বুলিয়ে দেয় এই স্মৃতির সঞ্চয়। পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, প্রিয় সহপাঠী অনেকেই আজ নেই। সেই অতিপরিচিত স্কুল প্রাঙ্গণ, রাস্তাঘাট, পারিপাশর্ি্বকতা_ সবকিছুই বদলে গেছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু বিস্মরণে যায়নি ছাত্রজীবনের অম্লমধুর স্মৃতি। আর তাই মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুল ও কলেজের ১৪৫ বছর পূর্তি উদযাপনের নানা আয়োজনে অনেকেই শামিল হয়েছিলেন ২৯ ডিসেম্বর। স্মরণের আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি প্রিয় স্কুলের উন্নতি সাধন, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য নানা সহায়তা, গুণীজন সম্মাননা, দুস্থ সহায়তা, প্রাক্তন ছাত্র তহবিল গঠন ইত্যাদি কর্মতৎপরতায় পূর্ণ হোক স্কুলের ১৪৫ বছর পূর্তি উৎসবের আয়োজনের ডালা।

শাহীন রহমান :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.