শঙ্কায় ভিয়েতনামের অর্থনীতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ ভিয়েতনাম । কৃষিনির্ভর দেশটি ১৯৮৬ সালে অবাধ বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করে। শিল্পায়নের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে দেশটির সরকার। দেখা যায়, শিল্পায়ন শুরু হয়ে যাওয়ায় মোড় ঘুরে যায় ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অবস্থার।
দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির দারিদ্র্যতা কমতে শুরু করে। বেকারত্ব কমতে শুরু করে। মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকে আর উন্নত হতে থাকে মানুষের জীবনযাত্রার মান। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮%। এর পর থেকে বিভিন্ন কারণে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকলেও ৭ ও ৬ পয়েন্টের মাঝেই ওঠা-নামা করছিল। সম্প্রতি ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এই প্রবৃদ্ধি হ্রাস অর্র্থনীতিবিদদের শঙ্কিত করে তুলছে। আইএমএফের তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালে ভিয়েতনামের মোট নমিনাল জিডিপি ১৩৫.৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হার পর্যবেক্ষণ করে গোল্ডম্যান স্যাচেশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটি বিশ্বের ১৭ তম অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। এইচএসবিসি ভবিষ্যত বাণী করেছিল যে, দেশটি ২০৫০ সাল নাগাদ নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও পর্তুগালকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ঘটনা বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে যেন মিথ্যাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম থাকার প্রভাবে ব্যাংকঋণ হ্রাস পাওয়ায় প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এই কারণে দেশটির সরকারকে আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের পাশাপাশি আরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চাপে থাকতে হবে। সৃষ্টি হয়েছে নাজুক পরিস্থিতির শঙ্কা।
গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কিন্তু এ বছর ঋণ কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি অনেকটা নিচে নেমেছে। ১৯৯৯ সালে এ ধরনের কম প্রবৃদ্ধির হার দেখা গিয়েছিল। সে সময় দেশটিতে ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি বছর বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ১৪ শতাংশ। এ বছর মোট ১ হাজার ২৭০ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে। অথচ গত বছর এই সময়ে এফডিআই ছিল ১ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার। এভাবে চলতে থাকলে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও বছরের শুরুর দিকে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। ২০১১ সালের আগের পাঁচ বছর পর্যন্ত দেশটির সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। এরও পাঁচ বছর আগে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোর মাঝে বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়াটাই প্রবৃদ্ধি হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কারণ অন্যান্য সেক্টরগুলোতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। শিল্প ও নির্মাণ খাত দেশটির অর্থনীতিতে ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ ভূমিকা রাখে। চলতি বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে জিডিপিতে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান রাখা সেবা খাতের কার্যক্রম বেড়েছে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষি, বনায়ন ও মাছ চাষ এখানকার অর্থনীতির ২১ দশমিক ৭ শতাংশ পূরণ করে থাকে, যা বেড়েছে ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যাংক ও সরকারী বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি কমছে। ভিয়েতনামের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের সাড়ে ৪ শতাংশই কুঋণ। এটা ভিয়েতনামের অর্থনীতির একটি নেতিবাচক দিক।
অর্থনীতির এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দেশটির ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দুর্বল অবস্থা এবং ব্যাংক পুনর্গঠনে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতেই ঋণমান কমানো হয়েছে। উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়াতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে। মূলত প্রবৃদ্ধি উত্তরণের লক্ষ্যে এ নিয়ে চলতি বছরে ষষ্ঠবারের মতো সুদের হার কমাল দেশটি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ায় ভিয়েতনামের ব্যাংক খাত কঠিন সময় পার করছে।
তাছাড়া দুর্বল ক্রয়ক্ষমতা ও মজুদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া বাজারের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশটির অর্থনীতিতে। তবে রফতানি বেশি হওয়ার কারণে দেশটির প্রবৃদ্ধি এখনও ব্যাপক হারে কমে যায়নি। এমনকি সমৃদ্ধ রফতানি গতির কারণে গত দুই দশকের মধ্যে এ বছর প্রথমবারের মতো দেশটি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
চলতি বছর ভিয়েতনামে রফতানি ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার। একই সময় আমদানি ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। ফলে এ বছর দেশটির বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত হয়েছে ২৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে দেশটিতে এ ধরনের উদ্বৃত্ত দেখা গিয়েছিল। দেশটিতে মূল্যস্ফীতিও ধীরে ধীরে কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ কম আসা, কুঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়া এবং ব্যাংকগুলোর দুর্বল অবস্থানের কারণে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও রফতানি বাণিজ্যসহ অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিকতা ভিয়েতনামকে খুব বেশি নাজুক অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে না বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে। ভিয়েতনামে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। তাছাড়া জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দেশটি প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ অন্যান্য খাতগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে সমর্থ হলে আর বিদ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে ভবিষ্যতে দেশটি সকল শঙ্কা দূর করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে।
এআরএস পাটোয়ারী

No comments

Powered by Blogger.