রম্য-শিক্ষা বাণিজ্য by সাইফুল আলম

আমার এ পড়ন্ত বয়সে এ ধরনের একটা চমকপ্রদ দৃশ্য যে অবলোকন করতে হবে তা ভাবতেও পারিনি। হ্যাঁ, এবার সে কথাই বলছি। আমার রিকন্ডিশন্ড শরীরটার পুরনো কল-কব্জাগুলোয় খানিকটা মুক্ত বাতাস চালিয়ে সার্ভিসিং করার জন্য বাড়ির সামনের পার্কটায় ঢুকলাম।
তখন দুপুরটা হামাগুড়ি দিয়ে বিকেলের দিকে এগোচ্ছিল। আমি খানিকটা ভেতরে যেতেই সামনের খোলা ছোট্ট মাঠটায় আমার বন্ধু কিসমিস আলীকে দেখলাম। কতকগুলো ছয়-সাত বছরের বাচ্চার সঙ্গে সে একটা ফুটবল নিয়ে বেশ খেলা খেলা খেলছিল। পরনে থ্রি কোয়ার্টার খাকি প্যান্ট, গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়ে কালো রঙের কেড্স। বাচ্চাগুলোও বেশ ফুর্তির সঙ্গে ওই ডাঁটা-চচ্চড়ি মার্কা দেহধারী মানুষটির সঙ্গে আমোদ করছিল। আমি নিজেকে আর পোষ মানাতে না পেরে মাঠের মধ্যে গিয়ে তাকে ইশারায় ডাকলাম। আমার পানে কিছুটা বিরক্ত সহকারে তাকিয়ে ও কাছে এলো। লক্ষ্য করলাম, ওর পুষ্টিহীন চৌচির ঠোঁট দুটোর মাঝে একটা ছোট্ট বাঁশি গোঁজা আছে। বললাম, 'কী বিষয় দোস্ত, এ ধরনের লাইভ শোর হেতুটা কী?' এবার ও হাড্ডি-চামড়া সজ্জিত শীর্ণ ডান হাতে মুখের বাঁশিটা মুক্ত করে বলল_ 'লক্ষ্য করেছ নিশ্চয়ই, আজকাল দেশের অধিকাংশ স্কুল-মাদ্রাসার বাচ্চাদের খেলাধুলার কোনো মাঠ নেই।' আমি বললাম, 'তা নেই, কিন্তু এই পার্কে তুমি বাচ্চাদের খেলাধুলা শেখাচ্ছ নাকি?'
'তা নয়, তবে শরীরচর্চার কিঞ্চিৎ প্রয়াস মাত্র।' এই বলে ও সামনের মাঠটার দিকে তাকাল। তারপর আমাকে উত্তর দেওয়ার সময় না দিয়ে বলল, 'শুধু তাই নয়, ওদের মানসিক আনন্দের জন্য বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণকে মাথায় রেখে ওদের ভিন্ন ভিন্ন নামও দিয়েছি, যেমন_ ক, খ, গ, ঘ, ঙ।' 'সে কী' আমি অবাক হয়ে শুধালাম। 'হ্যাঁ, দেখতে চাও?' এই বলে ও খানিকটা উচ্চস্বরে ডাকল_ 'এই যে মাস্টার ঙ, এদিকে একবার এস তো; আমি লক্ষ্য করলাম ওর আহ্বানে 'ঙ' নামধারী একটি নাদুস-নুদুস বালক দৌড়ে আমাদের দিকে এসে আমাকে সালাম দিয়ে দাঁড়াল। আমি কৌতূহলী কণ্ঠে শুধালাম, 'তোমরা বুঝি ফুটবল খেলছ।' ঙ বলল, 'শুধু খেলা নয়, দাদুর সঙ্গে আমরা ব্যায়ামও করি। আমি বললাম_ 'বাহ, বেশ ভালো তো।' ঙ এবার চটপটিয়ে বলল, 'স্কুলে খেলার কোনো মাঠ নেই তো তাই...' বলে ও দৌড়ে মাঠের মাঝে চলে গেল। ওর কথা শুনে আমি আমার ভাবনার দৃষ্টিটাকে খানিকটা প্রসারিত করার চেষ্টা করলাম। কিসমিস এবার তার হাতঘড়িটার দিকে একটু মোলায়েম দৃষ্টি ফেলে পৌনে দৌড়ের গতিতে পা চালিয়ে মাঠের মাঝে গিয়ে তার বাঁশিটায় লম্বা একটা ফুঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাগুলো হৈ রৈ করতে করতে মুহূর্তে আমার দৃষ্টিসীমাকে ফাঁকি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিসমিস পদলাঞ্ছিত বিধ্বস্ত বলটাকে আদর করে কোলে তুলে আমাকে নিয়ে মাঠের এক কোণে বসল। লক্ষ্য করলাম ও তার পরিশ্রান্ত ফুসফুসটায় ঘন ঘন বেশ ক'টা টাটকা দম ভরে নিল। আমি তাৎক্ষণিক কোনো প্রশ্ন না তুলে নীরব রইলাম। খানিক বাদে কিসমিস বলল, 'দোস্ত, সারাদেশে আজকাল সব ধরনের শিক্ষাকে মূলধন করে শিক্ষা বাণিজ্যটা বেশ বাজার দখল করেছে। বিষয়টা ভীষণ উদ্বেগজনক।' আমি বললাম, 'মানুষ আজকাল সব ধরনের পেশাকেই যেন ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করেছে।'
'কিন্তু এ কারণে সমাজ আর জাতি যে অচিরেই পঙ্কিলতার পদ্মভূষণ কণ্ঠে ধারণ করবে তা কখনও ভেবে দেখেছ?' কিসমিসের খাঁটি খেদ মিশ্রিত মন্তব্যটাকে আমি যথার্থ সম্মান দিয়ে বললাম, 'আজকাল অনেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে অনেক সময় অভিভাবকদের জিম্মি করে ফেলছেন। তা ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নূ্যনতম প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বা ব্যবস্থারও ঘাটতি আছে'। কিসমিস বলল, তবে রমরমা ভর্তি বিজ্ঞাপন, প্রাইভেট কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য, বস্তাভর্তি আর্থিক অনুদান, মাসিক বেতনের দুরমুজ পেটা আর্থিক ব্যয় পড়ূয়াদের অভিভাবকদের যেন পাগলা গারদে পাঠানোর উপক্রম করছে।'
আমি এবার বললাম, 'দোস্ত, শুধু দেশে কেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও আজকাল শিক্ষা বাণিজ্য ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা যেন অর্থের পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দৌড়াচ্ছে।
'হাঃ হাঃ হাঃ, কিসমিস এবার খোলা আসমানের শূন্যতায় হাসির একটা সাতরঙা রঙধনু ছিটিয়ে দিল। কোনো মন্তব্য প্রসব করল না। আমি কিসমিসের ফুরফুরে উৎফুল্লতাটাকে আরও খানিকটা স্যাচুরেটেড করার উদ্দেশে বললাম, 'সম্প্রতি গণমাধ্যমে হংকংয়ের শিক্ষা বাণিজ্যের একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে, তা কি লক্ষ্য করেছ?' আমার কথা শুনে কিসমিস উৎসাহিত কণ্ঠে বলল, 'আহা বিষয়টা ত্বরিত পেশ করেই ফেল না দোস্ত।' আমি বললাম, 'ইদানীং হংকংয়ের শিক্ষা কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিভিন্ন ধরনের মডেল সেজে জমকালো পোস্টারে প্রচার চালিয়ে শিক্ষার্থীদের নেশাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।' কিসমিস বলল, 'বিষয়টা প্রশংসনীয়, তবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে নাকি বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে নানা দেন-দরবারের কানাঘুষাও শোনা যায়।' সত্যি সেলুকাস! একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস যেন মুহূর্তের জন্য কিসমিসকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলল; আমি বললাম, 'তা ছাড়া খোদ রাজধানী ছাড়াও দেশের নানা স্থানে যত্রতত্র নানাশ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা বেশ অর্থ লুটে নিচ্ছে। শোনা যায়, এসবের নেপথ্যে নাকি কালো বিড়াল ম্যাঁও ম্যাঁও করে।' আমার সংলাপ শেষ হতেই কিসমিস যেন ভাবলেশহীন নেত্রে আমার পানে চেয়ে বলল, 'দোস্ত, তোমার আইকিউটা বেশ পুষ্টিকর। যত্ন করে পুষে রেখ।' আমি আমার চোখে-মুখে শরমের খানিকটা ফেস পাউডার বুলিয়ে বললাম, দোস্ত, বয়সের অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই আজকাল চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না'।
'তা যথার্থ বলেছ'_ কিসমিসের নির্লিপ্ত জবাব। আমি এবার আমাদের আলোচনার গতিতে আরও একটা ঊর্ধ্ব গিয়ার কষে বললাম, 'দোস্ত, আজকাল দেশের অনেক নামি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার শিক্ষা বাণিজ্যটাকে তাদের গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের তালিকাভুক্ত করে ফেলেছেন।' আমার কথা শেষ হতে কিসমিস হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার কোলের বলটায় হৃদয়হীনভাবে একটি হাই কিক মেরে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বলল_ 'হায় রে, কবে যে দেখতে পাব কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শূন্যে কোনো বিদ্যাপীঠ স্থাপন করে আধুনিক শিক্ষা বাণিজ্য শুরু করেছে!' বলটা শূন্যে কিছুক্ষণ ঘুরে সামান্য দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। সেদিকে লক্ষ্য করে আমি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, 'কিন্তু এসব শিক্ষা বাণিজ্য রোধের উপায় কী?' কিসমিস এবার প্রস্তরকঠিন কণ্ঠে বলল, 'সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নিদ্রাভঙ্গ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্মান প্রদর্শন করে সব ধরনের অনিয়মকারী- অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষ আর অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সব গ্রেডের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করতে হবে।' কথাগুলো শেষ করেই কিসমিস অদূরে দৃশ্যমান বলটার দিকে এগিয়ে গেল।

ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল

No comments

Powered by Blogger.