স্মৃতিবিজড়িত মধুর ক্যান্টিন- যাত্রা হলো শুরু

পহেলা জুলাই ১৯২১। যাত্রা শুরু ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। যার উদর থেকে জন্ম নিয়েছে বিখ্যাত সাহিত্যিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ।
যাদের মিলনমেলা বসত মধুর ক্যান্টিনে। আর এ মিলনমেলায় সবার প্রিয় মুখ শহীদ মধুসূদন দে (প্রিয় মধুদা)। ১৯১৯ সালের ১৯ এপ্রিল জন্ম শহীদ মধুসূদন দে’র।। পিতা প্রয়াত আদিত্য চন্দ্র দে। মা নিরদা সুন্দরী দে। বাবার হাত ধরে শুরু ক্যাটিন পরিচালনা।

মধুর ক্যান্টিনের পথচলা
আদিত্য চন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন মধুসূদন দে। তখন মধুসূদনের বয়স ১৪/১৫ বছর। সময় ১৯৩৪/১৯৩৫ সাল। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া লাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডাকসুর কার্যক্রম শুরু ও ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যান্টিন পরিচালনার ভার মধুদাকে দেয়া হয়। যদিও ক্যান্টিনটি ডাকসুর তবুও ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারীরা একে ‘মধুর স্টল’ বা মধুর ক্যান্টিন বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৬২ সালে বর্তমান কলাভবনের শিক্ষকদের লাউন্স রুমে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে চলে প্রায় পাঁচ বছর। তারপর ১৯৬৭ সালে স্থানান্তরিত বর্তমান মধুর ক্যান্টিনে।

নওয়াবের জলসা ঘর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন নওয়াবদের দান করা জমির ওপর। ১৯৬৭ সালে মধুর ক্যান্টিন স্থানান্তরিত হয় ডাকসুর অপর পাশে অর্থাৎ বর্তমান মধুর ক্যান্টিনে। নওয়াবের আমলে এটি ছিল জলসাঘর। এ ঘরেই নবাবরা বাইজি নাচাতেন। সূরা পান আমোদ প্রমোদে সময় কাটাতেন এ জলসাঘরে। এ ঘরটির সামনে দুই পাশে দুটি বৃত্তাকার সরু একতলা বিশিষ্ট ঘর আছে। এ ঘর দুটি বাইজিদের সাজঘর ও থাকার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ জলসাঘরেই ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মুসলিম লীগ।

রাজনীতির তীর্থস্থান
১৯০৬ সালে মধুর ক্যান্টিনেই জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সময়ের পথ ধরে ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা-চেতনায় জাগ্রত হতে থাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রস্ফুটিত হতে থাকে বিভিন্ন দাবি ও আন্দোলন। জমে উঠে ছাত্ররাজনীতি যার কেন্দ্রস্থল হয় আদিত্য ক্যান্টিন ও মধুর ক্যান্টিন। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ প্রতিষ্ঠার সময় মধুর ক্যান্টিনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যুব কর্মীদের। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের প্রস্তুতির আগে বায়ান্ন সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মধুর ক্যান্টিনই ছিল ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের অঘোষিত ক্যাম্প। বায়ান্ন সালে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠালগ্নেও একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এ ক্যান্টিন। এ সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন শহীদ মধুসূদন দে। ৫৪ যুক্তফ্রন্ট, আটান্ন, ষাট, বাষট্টির শিক্ষানীতিবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছয়ষট্টির ছয় দফার প্রধান পরিকল্পনা ও পরিচালনাগারে পরিণত হয়েছিল এ মধুর ক্যান্টিন। ’৬৮, ’৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি কর্মচঞ্চল ছিল এ ক্যান্টিন। রাজনৈতিক সভা আমতলা বটতলাতে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতো তখন তারা দৌড়ে আশ্রয় নিত মধু দার শীতল ছায়ায় নিচে। ’৭০-এর নির্বাচন পূর্ব রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এবং ’৭১ মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক আসলে মূল কর্মকা- এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও মধুর ক্যান্টিনের রাজনীতিকে কখনও আলাদা করে দেখেনি তৎকালীন সরকার। ভাষা আন্দোলনের সালাম, বরবত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ কামালসহ বর্তমান জাতীয় নেতাদের মধ্যে কার পদচারণা পড়েনি, কে মধুদার চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়নি এই মধুর ক্যান্টিনে এসে। মধুদা তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কখন যেন জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। তার সহিষ্ণু ব্যবহারে ও সেবার মাধ্যমে সবাইকে যেন আগলে রেখেছিলেন। সরকারের চাপে পড়ে যখন বিভিন্ন ছাত্র নেতারা গা-ঢাকা দিতেন তখন শুধুমাত্র যোগাযোগ থাকত মধুদার সঙ্গে। ছোট ছোট চিরকুটের মাধ্যমে খবর আদান-প্রদান করতেন তিনি। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় পোস্টার তিনিই লুকিয়ে রাখতেন ক্যান্টিনের বিভিন্ন গোপন জায়গায়। তাই ’৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীদের প্রকট নজরও ছিল এই ক্যান্টিনের প্রতি। সেই সূত্র ধরে রক্তচক্ষুর বাহিনীর ২৫ মার্চ ’৭১ সালে শাবল দিয়ে ভাঙতে শুরু করেছিল কিন্তু উর্দু বিভাগের এক শিক্ষকের বদৌলতে রেহাই পেয়েছিল আমাদের এই প্রিয় ক্যান্টিন।

সাহিত্য সংস্কৃতির আড্ডাশালা
রাজনৈতিক কর্মকা-ের পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির আসরও কম বসেনি এ রেস্তোরাঁয়। চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের বহু সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সূতিকাগার ছিল এটি। কে ক’টা কবিতা লিখেছে, কে সম্পন্ন করেছে তার লেখা প্রিয় গানটির সুর। এসব নিয়ে প্রত্যহ কেটে যেত মধুর সময়। কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আলী জাকের, আসাদুজ্জামান নূরসহ অসংখ্য গুণীজন তাদের পদচারণায় ধন্য করেছেন প্রিয় মধু দার ক্যান্টিন। কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো এখনও যারা জীবিত আছেন সময় পেলে তাঁরা এখনও ঘুরে যান বিচিত্র মায়াজালের স্মৃতির এ ফলকটি।

ভয়াল সেই রাত
২৫ মার্চ ’৭১ রাতে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুপুরীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সজীব শ্যামল ক্যাম্পাসে ছোপ ছোপ পড়ে ছিল রক্ত আর লাশ। হায়েনার দল পূর্বে থেকেই একটা নামের তালিকা তৈরি করেছিল যার মধ্যে ছিল মধুদার নাম। টিএসসি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যেতে প্রধান সড়কের পাশে ৩নং বিল্ডিং। এখানেই থাকতেন মধুদা ও তার পরিবার। ২৬ মার্চ ’৭১। সকাল আটটা। মধুদার কোয়ার্টারের চারপাশে গুলির শব্দ। মধুদাসহ পরিবারের সবাই বাসার (বড় মেয়ে বাদে) নরপশুর দল মধুদার বাসা চিনত না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হরিপ্রসাদ দেখিয়ে দেয় বাড়িটি। তারপর চলে মৃত্যুর এক ভয়ানক তা-ব। রক্তের পিপাসার্ত খেকো পোষাকীরা প্রথম গুলি চালায় সদ্য বিবাহিত মধুদার ছেলে রণজিৎ কুমারকে ও তার স্ত্রী রিনা রানীকে। রণজিৎ কুমার দের বুক ভেদ করে গুলি ঢুকে যায় রানু রায়ের বুকে। মধুদার স্ত্রী যোগমায়া দে রক্ষা পায়নি সেদিন। আর মধু দাকে নিয়ে যায় জগন্নাত হলের মাঠে। সেখানেই শহীদ হন মধুদা। জগন্নাত হলের গণকবরটির মধ্যে অসংখ্য হাড়ের মধ্যে মিশে আছেন আমাদের অভিভাবক অতিপ্রিয় মধুসূদন দে (প্রিয় মধুদা)।

মধুদার চা নাশতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার মিলনমেলা ছিল মধুর ক্যান্টিন। এখানে এসে এক কাপ চা না খেলে কি হয়। রাজনৈতিক নেতা তথা সবার কথা চিন্তা করেই মধু দা তৈরি করতেন ছোট ছোট মিষ্টি। অসাধারণ ছিল যার স্বাদ। শিঙ্গাড়া, সন্দেশ, চা ব্যস চার আনায় নাশতা কমপ্লিট। এছাড়াও পাওয়া যেত বাটার টোস্ট ডিম অমলেট, কাটলেট, ঘি প্রভৃতি। এখনও অনেক খাবারই পাওয়া যায় যার স্বাদ আগের মতো আছে। যদিও সেই খাঁটি ঘি এখন আর নেই।

অরুণ কুমারের মুখোমুখি
মধু দার মেয়ে প্রতিভার পর ছেলে অরুণ কুমার দায়িত্ব নেন এ রেস্তোরাঁর। বর্তমানে তিনিই পরিচালনা করছে এ ক্যান্টিন। কথা হয় অরুণ কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমার বাবা খাঁটি বাঙালী ছিলেন। তাঁর আদর্শ এই বুকে ধারণ করে আছি।
এই আদর্শকে ধরে রাখতে গিয়ে যদি আমার কোন শত্রুর সঙ্গেও সমঝোতা করতে হয় তবে আমি তাই করব, আর এই আদর্শে যদি আমার ছেলেমেয়ে বাদ সাধে তবুও আমি তাদের সঙ্গে সমঝোতা করব না।”

No comments

Powered by Blogger.