২০১২: রাজনীতিতে ছিল ব্যাপক আলোড়ন

২০১২ সালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনা ছিল লক্ষণীয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় বারাক ওবামার নির্বাচিত হওয়া, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের আবার প্রেসিডেন্ট হওয়া, মিসরে মোবারক-পরবর্তী গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড-সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসির প্রেসিডেন্ট হওয়া ও ইসলামপন্থীদের উত্থান, ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজের ক্ষমতায় বহাল থাকা, চীনে নেতৃত্বের পালাবদল—এমন অনেক ঘটনাই সারা বিশ্বে বেশ নাড়া দিয়েছে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ এখনো চলছে। সেখানে এ পর্যন্ত ৪৪ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। গাজায় ফিলিস্তিন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলি সেনাদের আট দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও ছিল আলোচনায়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া এবং সে দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে গুঞ্জনের কমতি ছিল না।
ওবামায় আস্থা: ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন বারাক ওবামা। দেশের দুই শতাব্দীর বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবেশ করেছিলেন হোয়াইট হাউসে। ৬ নভেম্বর সেই সাফল্যের রেকর্ড তিনি যেন নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। কারণ, মন্দায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি, নৈরাশ্যজনক বেকারত্বের ছায়া আর শেষ মুহূর্তে জ্বলে ওঠা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর কঠিন বাধা পেরিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য জনগণের রায় পেয়েছেন তিনি। মার্কিন ভোটাররা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন। সমীহ জাগানো ব্যবধানে রিপাবলিকান চ্যালেঞ্জারকে হারিয়েছেন বারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ (নির্বাচকমণ্ডলী) ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৩৩২টি, যেখানে জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৭০ ভোট। ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনি পেয়েছেন ২০৬ ভোট।
ক্রেমলিনে পুতিন: ভ্লাদিমির পুতিন তৃতীয় মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ৭ মে। এর মধ্য দিয়ে ছয় বছরের জন্য ক্রেমলিনে উঠলেন তিনি। তাঁর ক্রেমলিনে প্রত্যাবর্তনের প্রতিবাদে কয়েক দিন রাশিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীদের দমনে ব্যাপক ধরপাকড় করে সরকার। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য পুতিন অধিকার লঙ্ঘন করেছেন। এ ছাড়া গত ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। পুতিন যদি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেন, তাহলে তিনি জোসেফ স্তালিনের পর সবচেয়ে বেশি দিন মস্কো শাসনকারী সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের সমকক্ষ হবেন।
আবারও চাভেজ: গত ৭ অক্টোবরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হন ভেনেজুয়েলার নেতা হুগো চাভেজ। এর মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হলেন তিনি। নির্বাচনে জয়ী করে দেশের জনগণ আগামী ছয় বছরের জন্য দেশের শাসনভার আবার বামপন্থী এই নেতার হাতে অর্পণ করেছে। গত এক দশকের মধ্যে এই নির্বাচনকে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলে মনে করা হয়। নির্বাচন পর্ষদঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ পেয়েছেন ৫৪ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। চাভেজ ১৯৯৯ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। গত বছর ক্যানসারের চিকিত্সা নেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও তাঁর পুনর্নির্বাচিত হওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় ছিল।
চীনে নতুন নেতৃত্ব: চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ১৮তম সম্মেলনে দেশের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছে। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সিপিসির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পলিট ব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে শি জিনপিং ও লি কেকিয়াং ছাড়া স্থান পেয়েছেন ঝাং দেজিয়াং, ইউ ঝেংশেং, লিউ ইউনসান, ওয়াং কিসান ও ঝাং গাওলি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মার্চে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন জিনপিং। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবেন কেকিয়াং। অন্যরাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবেন। জিনপিং বর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কেকিয়াং দায়িত্ব পালন করছেন উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে। সিপিসির ১৮তম সম্মেলন ৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ১৪ নভেম্বর শেষ হয়। এবারের সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন দলীয় নেতারা। এ জন্য দলের শাসনতন্ত্রেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সংস্কারই হবে নতুন নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
জাপানের ক্ষমতায় শিনজো: প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের রেকর্ড গড়ে জাপানের ভোটারদের চরমভাবে হতাশ করেছে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টি (ডিপিজে)। এ কারণে পার্লামেন্ট নির্বাচনে এই দলের ভরাডুবি হয়েছে। শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) পেয়েছে বিপুল বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর জাপানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট নেওয়া হয়।
পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ফিলিস্তিন: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জাতিসংঘের অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে ফিলিস্তিন। গত ২৯ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে এ-বিষয়ক প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে অনুমোদিত হয়। এর মধ্য দিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পথে ফিলিস্তিন আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশ কটি দেশ এবং রাশিয়া, চীন, ভারতসহ মোট ১৩৮টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ মাত্র নয়টি দেশ এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ৪১টি দেশ। ফিলিস্তিন এত দিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘পর্যবেক্ষক ভূখণ্ড’ হিসেবে যোগ দিত। এখন তারা ‘সদস্য নয় এমন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে মর্যাদা পাবে। এখন থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি জাতিসংঘ অধিবেশনের বিতর্কে অংশ নিতে পারবেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই রায়কে সার্বভৌম ফিলিস্তিনের ‘জন্মসনদ’ বলে অভিহিত করেছেন। সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের এই মর্যাদার উন্নীতকরণে যুক্তরাষ্ট্র ‘হতাশা’ ও ইসরায়েল ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত: যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত একটি ইসলামবিরোধী চলচ্চিত্রের জেরে ১১ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার বেনগাজিতে অবস্থিত মার্কিন উপদূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্সসহ একজন সেনা ও দুই কর্মকর্তা নিহত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পরবর্তী রাজনীতিতে বেনগাজির ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। রিপাবলিকানদের অভিযোগ, লিবিয়ায় মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরালো করার আহ্বান অগ্রাহ্য করেছে ওবামা প্রশাসন। ওই হামলার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ওবামাকে স্বস্তি দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন।
মালালা গুলিবিদ্ধ: গত ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই তালেবানের গুলিতে আহত হয়। নারীশিক্ষার উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তালেবানের রোষানলে পড়ে অকুতোভয় এই কিশোরী। একই ঘটনায় তার দুই সহপাঠীও আহত হয়। এ ঘটনায় সারা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে চিকিত্সা নিচ্ছে মালালা।
মিয়ানমারে সহিংসতা: গত জুনের পর থেকে রাখাইন রাজ্যের জাতিগত বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার দুই দফার সহিংসতায় মিয়ানমারে লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া হয়। সহিংসতায় সেখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। হাজার হাজার ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সরকারি হিসাবে দুই দফা সহিংসতায় কমপক্ষে ১৬৮ জন নিহত হয়েছে।
মিসরের খসড়া সংবিধান: মিসরে বছরজুড়ে চলেছে রাজনৈতিক সংকট। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নতুন সংবিধানকে কেন্দ্র করে এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর মুরসির ডিক্রি জারির পর সেখানে সহিংস বিক্ষোভ ও ধর্মঘট শুরু হয় এবং ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসির সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধ তৈরি হয়। পার্লামেন্টে পাস হওয়া খসড়া সংবিধানের ওপর গণভোটের ডাক দেন মুরসি। ১৫ ডিসেম্বর প্রথম দফায় এবং ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটের রায় খসড়া সংবিধানের পক্ষে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.