অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অভাবে গতিহীন আওয়ামী লীগ-তৃণমূল নেতাদের অভিমত by পাভেল হায়দার চৌধুরী

অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে গতিশীল হচ্ছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আসা নতুন ও তরুণ নেতৃত্ব সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করতে পারেনি।
সাংগঠনিক ভিত শক্ত করতে এবং আগামী দিনে বৈরী পরিবেশ মোকাবিলায় প্রয়োজন সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা দলের নেতৃত্ব ও সরকার সম্পর্কে কালের কণ্ঠের কাছে খোলামেলা মত প্রকাশ করেন।
দলের মাঠ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানে সমন্বয়ের অভাব। একেবারে নবীনদের দিয়ে ঐতিহাসিক এই সংগঠনের রাজনৈতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবে না। প্রবীণ, ত্যাগী ও সংগ্রামী নেতৃত্ব প্রয়োজন। দলীয় নেতৃত্বে দরকার নবীন-প্রবীণের সম্মিলন। তা ছাড়া দলের দায়িত্বশীল কাউকে সরকারের দায়িত্বে রাখা ঠিক নয় বলেও মনে করেন অনেকে।
অনেক কাউন্সিলর ও ডেলিগেট বলেন, তারুণ্যনির্ভর বিদায়ী কমিটি দলে গতি আনতে পারেনি। এবার সম্মেলনে এ ধারা পরিবর্তন না হলে দলের সর্বস্তরে আরো স্থবিরতা নেমে আসবে। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে দল। দলকে ঢেলে সাজাতে না পারলে আগামী দিনে বিপর্যয়ের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন কেউ কেউ।
তৃণমূল নেতারা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল হলেও বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার ওপর অনাস্থা তাঁদের। তাঁরা সরকারের সফলতা ব্যর্থতা নিয়েও কথা বলেন। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াও কৃষি, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে সরকারের সফলতার কথা তুলে ধরেন তাঁরা। পাশাপাশি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি এবং ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্ধশতাধিক তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা বলে এ অভিমত জানা গেছে।
বিদায়ী কমিটি সাংগঠনিক গতিশীলতা আনতে পারেনি : নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম বলেন, আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আসা নেতৃত্ব সাংগঠনিক গতিশীলতা আনতে পারেনি। সাংগঠনিক গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করতে প্রয়োজন সংগ্রামী নেতৃত্ব। আন্দোলন সংগ্রাম মোকাবিলা অন্য জিনিস। নেতৃত্ব আসা উচিত রাজপথ থেকে। সরকারের চার বছরের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা সরকারের বড় সাফল্য আর বড় ব্যর্থতা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ।' তৃণমূল সম্মেলন শেষ না করে জাতীয় সম্মেলন কতখানি মঙ্গলজনক হবে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
গত কমিটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন কাদের বলেন, সাংগঠনিকভাবে আরো গতিশীল হওয়া উচিত ছিল। তোফায়েল, আমু, সুরঞ্জিত, জলিলদের বাদ দিয়ে যে চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনা নিয়েছেন, এই কমিটি সে শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। আবার তাঁদের ফিরিয়ে আনা উচিত।
প্রবীণদের সভাপতিমণ্ডলীতে রাখা দরকার : কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিল আহমেদ বলেন, 'তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা উচিত। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উপদেষ্টা পরিষদে নয়, নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীতে রাখা দরকার।'
মাগুরা পৌর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিন বলেন, 'বর্তমান নেতৃত্বের সাহস নেই। সভাপতিমণ্ডলীর অনেক সদস্যের রাজনৈতিক ইতিহাস নেই। আমু, তোফায়েল, সুরঞ্জিত এরা পরীক্ষিত নেতা। তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। কাউন্সিলে সত্যিকার অর্থে ভোটাভুটি করা হলে জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা বাদ পড়বেন।'
নীলফামারীর ডোমার উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রবীণদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। দলের দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের মন্ত্রীর দায়িত্বে না রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মন্ত্রী চাই। এ ক্ষেত্রে যাঁরা মন্ত্রী থাকবেন তাঁদের দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। তবেই সাংগঠনিক গতিশীলতা আসবে। সরকারও ভালো চলবে। প্রবীণদের মূল্যায়ন চাই।'
'ওয়ার্ল্ড কাপ খেলোয়াড়রা' মাঠের বাইরে থাকলে ভালো হবে না : জামালপুর থেকে আসা কাউন্সিলর শাহ নেওয়াজ সরকার বলেন, 'আমু, তোফায়েল, জলিল ও সুরঞ্জিত ওয়ার্ল্ড কাপ খেলোয়াড়। তাঁরা মাঠের বাইরে বসে আছেন। এটা দলের জন্য ভালো হবে না। আমরা তাঁদের অন্তর্ভুক্তি চাই।'
সাধারণ সম্পাদককে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা দরকার : মাগুরার শ্রীপুর থেকে ডেলিগেট হিসেবে আসা মিয়া নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমু, তোফায়েল, জলিল ও সুরঞ্জিতকে সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এত দিন ধরে সংস্কারপন্থী পরিচয় জিইয়ে রাখা ঠিক নয়।' সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হলে দলের সাধারণ সম্পাদককে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, 'সাধারণ সম্পাদককে শুধু দলীয় কাজকর্ম দেখভালের দায়িত্বে রাখা উচিত। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে আমাদের সাধারণ সম্পাদককে আমরা সেভাবে পাইনি।'
একদিনের কাউন্সিলে পতাকা ওড়ানোই সার : কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থেকে আসা কাউন্সিলর রফিকুল হোসেন বলেন, পুরনো বা পরীক্ষিত নেতাদের কমিটিতে জায়গা না দেওয়া হলে চমক থাকবে না। একদিনের কাউন্সিলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'কাউন্সিল উপলক্ষে তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় নিয়ে এসে পতাকা ওড়ানো ছাড়া কোনো কাজ নেই।'
জামালপুরের শাহ নেওয়াজ সরকারও একদিনের কাউন্সিলের সমালোচনা করে বলেন, 'হঠাৎ একদিনের কাউন্সিল, উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। জেলা, থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন সম্মেলন বাদ রেখে জাতীয় সম্মেলন শুভ ফল বয়ে আনবে না।'
সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই আছে : ফুলবাড়ী উপজেলার ডেলিগেট অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন কাদের বলেন, সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই আছে। চরম ব্যর্থতা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি এবং ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হতেই হবে। সফলতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের' বিচার শুরু করা অন্যতম। কমিটি কেমন প্রত্যাশা করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নেত্রী (শেখ হাসিনা) যেটা ভালো মনে করেন সেটাই।'
বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু : বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শরণখোলা উপজেলা সভাপতি কামাল উদ্দিন আকন বলেন, সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু। এর সমাধান জরুরি।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট দেওয়ান আবদুল জলিল বলেন, সরকারের সফলতা শতভাগ নেই। ব্যর্থতা আছে। তবে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। দলীয় সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে তিনি বলেন, দায়িত্বে ব্যর্থ, তবে বিশ্বস্ত। প্রবীণদের কমিটিতে আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
প্রবীণদের নিয়ে সমালোচনাও আছে : দলের প্রবীণ নেতাদের নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন বগুড়া থেকে আসা কাউন্সিলর রাগেবুল আহসান। সংস্কারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত নেতাদের এক-এগারো পরবর্তী ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ওঁরা ক্ষমতায় এলে আপা (শেখ হাসিনা) নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন। কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন তাঁরা।'
নেত্রীর প্রতি শত ভাগ আস্থা : দলের পটুয়াখালী জেলা কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, 'নেত্রীর (শেখ হাসিনা) প্রতি শত ভাগ বিশ্বাস ও আস্থা আছে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন মেনে নেব। এমনকি পুরনোদের বাদ দিলেও মেনে নেব।'

No comments

Powered by Blogger.