প্রতি বর্গমিটার ৪০৫.৮৫ টাকা দরের কাজ জালিয়াতির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে ৪,০০৫.৮৫ টাকা- ঝিনাইদহে সড়কের কাজে কোটি টাকা আত্মসাৎ by আজাদ রহমান

কাজটি ছিল পাথর ও পিচের মিশ্রণে বড় বড় গর্ত সংস্কারের। প্রতি বর্গমিটার ওই কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৪০৫.৮৫ টাকা। কিন্তু ৮৮৭ শতাংশ বেশি দর দেখিয়ে কাজটি করানো হয়েছে ৪,০০৫.৮৫ টাকায়। প্রতি ঘনমিটার ১,৮৭৭.১১ টাকার আরেকটি কাজ করানো হয়েছে ৪,৮৭৭ টাকায়।
এভাবে ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ছয় ধরনের কাজে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ে কাজ করিয়েছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এতে পাঁচ কোটি টাকার কাজে সরকারের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া ইসলাম সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে অতিরিক্ত দরে কাজ দিয়েছেন বলে অন্য ঠিকাদারেরা অভিযোগ করেছেন।
প্রকৌশলী জাকারিয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুলে একটি শূন্য বেশি পড়ায় ৪০৫ টাকার বদলে ৪,০০৫ টাকা হয়েছে। একইভাবে একের বদলে চার বসায় ৪,৮৭৭ টাকা হয়েছে।’
দরপত্রে ‘ভুল’ সংখ্যা উল্লেখ করা ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া প্রসঙ্গে জাকারিয়া দাবি করেন, ‘ভুল সংখ্যার বিষয়টি চোখ এড়িয়ে গেছে। কোনো দুর্নীতির জন্য ইচ্ছে করে এমনটি করা হয়নি।’
ঝিনাইদহ এলজিইডি থেকে জানা গেছে, মহেশপুর থেকে বাঘাডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তার বিভিন্ন স্থানে সংস্কারকাজ সম্প্রতি শেষ করে এলজিইডি। পাকা ওই রাস্তার বেশ কিছু জায়গায় গর্ত তৈরি হয়। অনেক স্থান ভেঙেচুরে যাওয়ায় রাস্তায় চলাচল কষ্টকর হয়ে ওঠে। এলজিইডি কর্তৃপক্ষ ওই রাস্তা সংস্কারের জন্য এ বছরের শুরুতে একটি প্রকল্প তৈরি করে। এলজিইডির নির্ধারিত কোডের দর অনুযায়ী, রাস্তা উন্নয়নে বিভিন্ন কাজে পাঁচ কোটি নয় লাখ ১১ হাজার ৩৩২ টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়। এরপর দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে ১৮ জন ঠিকাদার অংশ নেন। দরপত্র যাচাই-বাছাই শেষে মেসার্স লিটন ট্রেডার্সকে কাজটি দেয় এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
লিটন ট্রের্ডাসের মালিক লিটন হোসেন বলেন, ‘কাজটি আমার লাইসেন্সে হলেও মূলত করেছেন ঝিনাইদহের ঠিকাদার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি পাঁচ কোটি নয় লাখ ১১ হাজার ৩৩২ টাকার কাজটি তিন কোটি ৮০ লাখ ৯৭ হাজার ৭০৩ টাকায় করে দেবেন বলে এলজিইডির সঙ্গে চুক্তি করেন।’
সাধারণ ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্র জমা ও সেই অনুযায়ী রাস্তা সংস্কারকাজে প্রায় এক কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। অনুসন্ধান করে ওই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
কাজের আগেই দুর্নীতি: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ও কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, প্রাক্কলন তৈরির সময় রাস্তা সংস্কারের পুরো কাজকে ২২টি খাতে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে ইটের কাজ, মাটির কাজ, পাথরের কাজ, শ্রমিকদের খরচ, রোলার খরচসহ সব খরচ ধরা হয়েছে। এলজিইডি কর্তৃপক্ষ এসব খাতে তাদের নির্ধারিত কোড অনুযায়ী খরচ নির্ধারণ করে। এমন একটি কাজ ছিল দুই ইঞ্চি পরিমাণ পাথর ও পিচের মিশ্রণে ৯৬৭ দশমিক ৫১ বর্গমিটার স্থানে বড় বড় গর্ত সংস্কার করা। কোড অনুযায়ী, প্রতি বর্গমিটার ওই কাজের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ৪০৫.৮৫ টাকা। কিন্তু কাজটি ৪,০০৫.৮৫ টাকা দরে পেয়েছেন ঠিকাদার। কাজ শেষে ঠিকাদার ৯৬৭ দশমিক ৫১ বর্গমিটারের পরিবর্তে এক হাজার ৩০৬ দশমিক ৮১ বর্গমিটারের কাজ করেছেন দাবি করে বিল জমা দেন। এতে তিন লাখ ৯২ হাজার ৬৬৩ টাকা ৯৩ পয়সার কাজের বিল দাঁড়ায় ৫২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৮৪ টাকা ৮৪ পয়সা। এই কাজে সরকারের ক্ষতি হয় ৪৮ লাখ ৪২ হাজার ২২০ টাকা ৯১ পয়সা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঠিকাদার অতিরিক্ত কাজের বিল তুললেও ৯৬৭ দশমিক ৫১ বর্গমিটারের বেশি কাজ করেননি।
একইভাবে রাস্তায় দুই ইঞ্চির নিচে খোয়া বসিয়ে রোলার দিয়ে সমান করার (ডব্লিউবিএম) কাজে প্রতি ঘনমিটারে দর ছিল এক হাজার ৮৭৭ টাকা ১১ পয়সা। কাজটি করা হয়েছে চার হাজার ৮৭৭ টাকা দরে। এক হাজার ৩৮৬ দশমিক ৪০ ঘনমিটারের ওই কাজে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৪১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা।
ডব্লিউবিএম ভাঙা একটি কাজের প্রাক্কলিত দর ছিল ঘনমিটার প্রতি ১৬০ টাকা ৪৯ পয়সা। ১৮২ দশমিক ৩৩ ঘনমিটারের কাজটি করা হয়েছে ১৮০ টাকা দরে।
এভাবে ছয়টি খাতে অতিরিক্ত দর জমা দিয়ে কাজ করেছেন ঠিকাদার আসাদুজ্জামান।
সংস্কারকাজে নয়ছয়: মহেশপুর থেকে বাঘাডাঙ্গা সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, বড় বড় গর্ত থাকা জায়গাগুলো খুঁড়ে নতুন করে নির্মাণের কথা থাকলেও ঠিকাদার ওই সব গর্তে ভাঙা ইট ফেলে ভরাট করে ওপরে পিচ ঢেলেছেন। রাস্তায় কার্পেটিং করার পর সিলকোট হওয়ার কথা থাকলেও শুধু সিলকোট করা হয়েছে। দাড়িয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের সড়কে ফাটল ধরে বিশাল অংশ দেবে গেছে।
নিম্নদরের কাজ করেননি: দরপত্রে উচ্চদর দেওয়ার পর কাজটি পাওয়া নিশ্চিত করতে ঠিকাদার আসাদুজ্জামান রাস্তার পাশে মাটি ভরাটের কাজে ৮৮ শতাংশ নিম্নদর দেন। পুরো কাজ পাওয়ার পর লোকসান এড়াতে মাটি ভরাটের কাজ করেননি ঠিকাদার। এ জন্য মাটির কাজের বিলও তিনি নেননি।
রাস্তার পাশে মাটি না থাকায় সদ্য সংস্কার শেষ হওয়া মহেশপুর-বাঘাডাঙ্গা সড়কের অনেক স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। কাজটি না করায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি এলজিইডি।
ঝিনাইদহ এলজিইডি ভবনে ঠিকাদার আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী কাজের বিল নিয়েছি। কোনো অনিয়ম করিনি।’
এলজিইডি কর্মকর্তাদের বক্তব্য: মহেশপুর উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া ইসলাম বলেন, ‘চুক্তিতে ভুল হয়েছে। তবে বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে যে দরে চুক্তি হয়েছে তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’
গর্ত ভরাট কাজের আয়তন বৃদ্ধি ও মাটি ভরাটের কাজ না-করা প্রসঙ্গে জাকারিয়া বলেন, ‘সরেজমিনে কাজ করতে গেলে এ রকম আয়তন বাড়তে পারে। ঠিকাদার কিছু কিছু স্থানে রাস্তার পাশে মাটি ভরাটের কাজ করেছেন। যেটুকু কাজ করেছেন সেটুকুর বিল দেওয়া হয়েছে।’
কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মহেশপুর এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আলেয়া খাতুন বলেন, ‘সংস্কারকাজের পর যে স্থানগুলো ভেঙে গেছে সেগুলো আবার ঠিক করার জন্য মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু হয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.