অনন্য শিক্ষাবিদ by মো. খালেকুজ্জামান
ঢাকা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. হাফিজ উদ্দিনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ২৯ ডিসেম্বর। অধ্যবসায় ও যোগ্যতা দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে কতটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব_ এ দেশে যত গুণী মানুষ তার প্রমাণ দিয়েছেন অধ্যক্ষ মো. হাফিজ উদ্দিন ছিলেন তার অন্যতম।
সাভার থানার নলাগড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এ মহান শিক্ষাব্যক্তিত্ব ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মানসহ এমকম ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর সাভার কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকেও তিনি কিছুদিন চাকরি করেন। কিন্তু যার মনমানসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রী নিয়ে ভাবনা তার সেই চাকরি ভালো লাগার কথা নয়। তাই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভালো চাকরি ছেড়ে ১৯৭১ সালে ঢাকা সিটি কলেজে পূর্ণকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে বলতে গেলে অল্প বয়সেই ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন কলেজে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪০ জন। তবে তার জন্য বড় পাওয়ার বিষয় ছিল সে সময়ের কলেজ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব খানে আলম খানের স্নেহ ও সাহচর্য। তরুণ অধ্যক্ষের ভাবনা, কীভাবে ঢাকা সিটি কলেজ একদিন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে উঠবে। মেধাবী হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর কলকাকলি আর এক ঝাঁক শিক্ষানুরাগী, মেধাবী ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকমণ্ডলীর পদচারণায় ক্লাসরুম, করিডোর, প্রাঙ্গণসহ সর্বত্র এক শিক্ষার মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান পর্যায়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হলো ১৯৭৭ সালে। তিনি ১৯৭৯ সালেই কলেজে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করেন। তার ভাষ্যমতে, ছেলেরা পরীক্ষা দিতে চায় না, ক্লাস করতে চায় না, কতভাবে বুঝিয়ে ক্লাসরুমে ও পরীক্ষার হলে নিয়ে আসতে হয়েছে। ছাত্রসংখ্যা তেমন না থাকলে কী হবে, তখনও কলেজে ছাত্ররাজনীতি ছিল। কতভাবে ছাত্রছাত্রী ও তৎকালীন ছাত্র নেতাদের বুঝিয়ে তা বন্ধ করলেন। এ জন্য প্রথম দিকে কতটা ঝুঁকি নিতে হয়েছে_ তা তার সে সময়ের সহকর্মীদের কাছে যখন শুনতাম, তখন এ বিদ্যানুরাগী ব্যক্তির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে যেত। খানে আলম খানের সহযোগিতায় কীভাবে বলাকা সিনেমা হলে শিক্ষকদের পাঠিয়ে চ্যারিটি শোর টিকিট বিক্রি করে অর্থসংস্থান করেছেন তা এখন শুনলে কে বিশ্বাস করবে?
আমি ১৯৮৪ সালের প্রথম দিকে কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই, মোট শিক্ষক ছিলেন ২৫ জন। আর যখন তিনি কলেজ রেখে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর পরপারের ডাকে সাড়া দিলেন, তখন অনেক বিভাগেই শিক্ষক সংখ্যা ২৫-এর মতো। প্রায় ২০০ শিক্ষক, ১২ হাজার ছাত্রছাত্রী ও ৫০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী রেখে গেলেন। ৬ তলা ৪টি বড় বড় ভবন করেছেন। সরকার বা কারও কাছ থেকে একটি টাকাও নেননি। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি কখনও কৃপালাভের জন্য কারও কাছে ধরনা দেননি। ৮৩টি এসি লাগানো ক্লাসরুম, ৩টি সুপরিসর লাইব্রেরি, অনেকগুলো কম্পিউটার ও বিজ্ঞান ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সব ভৌত সুযোগ-সুবিধা রেখে গেছেন। এসব সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই যত্নশীল। পাঠদান, পরীক্ষা পদ্ধতিসহ সব ক্ষেত্রে সবসময়ই নতুনত্ব এনে উন্নয়নের চিন্তা করেছেন। শিক্ষকমণ্ডলীর প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এগুলো নিয়ে দিন-রাত ভেবেছেন। সাধারণভাবে শিক্ষার্থীরা তাকে ভয় পেলেও তার রুমে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ছিল অবাধে আসা-যাওয়ার সুযোগ। কোন ছাত্রের কোন স্যারের সহায়তা লাগবে_ সে বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিতেন। ছাত্রছাত্রীদের থেকে নোট রেখে দিয়ে তা শিক্ষকদের দেখিয়ে ফেরতের ব্যবস্থা করতেন। নিজে হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন বিধায় অঙ্ক দেখানোর জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিড় করত। হাজারো কাজের মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন পূরণে কখনোই বিরক্ত হতেন না।
ঢাকা সিটি কলেজ আছে, তার সেই চেয়ার আছে, আমরা আছি; কিন্তু তিনি নেই। অধ্যক্ষ মো. হাফিজ উদ্দিন টিকে আছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে।
md.khalequzzaman1@gmail.com
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান পর্যায়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হলো ১৯৭৭ সালে। তিনি ১৯৭৯ সালেই কলেজে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করেন। তার ভাষ্যমতে, ছেলেরা পরীক্ষা দিতে চায় না, ক্লাস করতে চায় না, কতভাবে বুঝিয়ে ক্লাসরুমে ও পরীক্ষার হলে নিয়ে আসতে হয়েছে। ছাত্রসংখ্যা তেমন না থাকলে কী হবে, তখনও কলেজে ছাত্ররাজনীতি ছিল। কতভাবে ছাত্রছাত্রী ও তৎকালীন ছাত্র নেতাদের বুঝিয়ে তা বন্ধ করলেন। এ জন্য প্রথম দিকে কতটা ঝুঁকি নিতে হয়েছে_ তা তার সে সময়ের সহকর্মীদের কাছে যখন শুনতাম, তখন এ বিদ্যানুরাগী ব্যক্তির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে যেত। খানে আলম খানের সহযোগিতায় কীভাবে বলাকা সিনেমা হলে শিক্ষকদের পাঠিয়ে চ্যারিটি শোর টিকিট বিক্রি করে অর্থসংস্থান করেছেন তা এখন শুনলে কে বিশ্বাস করবে?
আমি ১৯৮৪ সালের প্রথম দিকে কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই, মোট শিক্ষক ছিলেন ২৫ জন। আর যখন তিনি কলেজ রেখে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর পরপারের ডাকে সাড়া দিলেন, তখন অনেক বিভাগেই শিক্ষক সংখ্যা ২৫-এর মতো। প্রায় ২০০ শিক্ষক, ১২ হাজার ছাত্রছাত্রী ও ৫০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী রেখে গেলেন। ৬ তলা ৪টি বড় বড় ভবন করেছেন। সরকার বা কারও কাছ থেকে একটি টাকাও নেননি। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি কখনও কৃপালাভের জন্য কারও কাছে ধরনা দেননি। ৮৩টি এসি লাগানো ক্লাসরুম, ৩টি সুপরিসর লাইব্রেরি, অনেকগুলো কম্পিউটার ও বিজ্ঞান ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সব ভৌত সুযোগ-সুবিধা রেখে গেছেন। এসব সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই যত্নশীল। পাঠদান, পরীক্ষা পদ্ধতিসহ সব ক্ষেত্রে সবসময়ই নতুনত্ব এনে উন্নয়নের চিন্তা করেছেন। শিক্ষকমণ্ডলীর প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এগুলো নিয়ে দিন-রাত ভেবেছেন। সাধারণভাবে শিক্ষার্থীরা তাকে ভয় পেলেও তার রুমে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ছিল অবাধে আসা-যাওয়ার সুযোগ। কোন ছাত্রের কোন স্যারের সহায়তা লাগবে_ সে বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিতেন। ছাত্রছাত্রীদের থেকে নোট রেখে দিয়ে তা শিক্ষকদের দেখিয়ে ফেরতের ব্যবস্থা করতেন। নিজে হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন বিধায় অঙ্ক দেখানোর জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিড় করত। হাজারো কাজের মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন পূরণে কখনোই বিরক্ত হতেন না।
ঢাকা সিটি কলেজ আছে, তার সেই চেয়ার আছে, আমরা আছি; কিন্তু তিনি নেই। অধ্যক্ষ মো. হাফিজ উদ্দিন টিকে আছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে।
md.khalequzzaman1@gmail.com
No comments