অভিনব কৌশলে জালিয়াতি, অবৈধ ভর্তি ঠেকানো যাচ্ছে না ঢাবিতে- ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষায় ৫ জনের বিরুদ্ধে মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়ার অভিযোগ- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের by আসিফ ত্বাসীন

কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধ ভর্তি। জালিয়াত চক্রগুলো দিনকে দিন নানা পন্থা বের করে ফেলছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কৌশলে মার খেয়ে যাচ্ছে প্রশাসন-পুলিশ-গোয়েন্দারা।
গত ডিনস কমিটির বৈঠকে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাঁচ ভর্তিচ্ছুর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়ার অভিযোগ তুলেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবছরই পরীক্ষার সময় কোন না কোন জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। বেশ তৎপর হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায় না। অভিযোগের পর গ্রেফতার-বহিষ্কার কিংবা এ বিষয়ে ‘খোঁজ নেয়া’ হয়। কিন্তু প্রকৃত জালিয়াতি বন্ধে তা কি ধরনের প্রভাব রাখছে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
অতীত অনুসন্ধানে দেখা যায়, দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পারা, মোবাইল ফোন-ঘড়ি এসব ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বহন আইন অকার্যকর, পরীক্ষা কেন্দ্রের কতিপয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসাধুতা ও নতুন নতুন জালিয়াত চক্রের উদ্ভবের মূলোৎপাটন করতে না পারায় প্রতিবছর এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয় পরীক্ষাটিকে ঘিরে। প্রশাসনের তোড়জোড় শোনা যায়। কিন্তু পরবর্তী বছর ঘটে আবারও নতুন উপায়ে, নতুন আঙ্গিকে জালিয়াতির ঘটনা। প্রশাসন একটি ঘটনার সন্ধান চালাতে চালাতে নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করে ফেলে চক্রগুলো।
গত বুধবার ডিনস কমিটির বৈঠকে অভিযুক্ত পাঁচ জনের অবস্থান মেধাতালিকায় ১৫০ এর মধ্যে। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধানের জন্য বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির বৈঠকে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সহিদ আকতার হোসাইনকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অথচ ইতোমধ্যে তাদের সাক্ষাতকার গ্রহণের মাধ্যমে বিষয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এর আগের বছরের জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছিল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। ভর্তি পরীক্ষার সাক্ষাতকার চলাকালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জালিয়াতি করে পরীক্ষা দিয়েছে এমন দুই শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় ১২তম ও ৪৪তম স্থান অধিকারী এ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে কোচিং সেন্টারের সংশ্লিষ্টতার কথা। তাদের সঙ্গে জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আরও অনেকের তথ্য প্রক্টর অফিসে থাকলেও তাদের সম্পর্কে কতটুকু ‘খোঁজ’ রাখা হচ্ছে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ওয়াকিবহাল নয়। অথচ সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেছিলেন, আরও যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের ভর্তি করা হলেও তাদের সম্পর্কে সব সময় খোঁজ রাখা হবে। যে বিভাগেই ভর্তি হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠানো হবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারা এখন বহাল তবিয়তে তাদের শিক্ষাজীবনের এক বছর শেষ করেছে। অধ্যয়নরত আছে বিভিন্ন বিভাগে। যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদেরও ‘খোঁজ রেখে’ পরবর্তী সময়ে ডেকে পাঠানো হবে বলে জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে কারও কাছে কোন তথ্য নেই। এমনকি সে চক্রের মূল হোতাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এখন সরকারী ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
এ ঘটনারও আগের বছরের ভর্তি পরীক্ষার সময় ছাত্রদলের এক নেতার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠেছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণের অভাবে কিছু করা যায়নি। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সময় পুলিশ ও র‌্যাবের সহায়তায় আটজনকে আটক করা হয়েছিল। তাদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে প্রশাসনের নিকট কোন সংবাদ নেই।
গত বছর ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষা চলাকালে বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ থেকে আটককৃত শহীদুল নামে এক শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে সেদিনকার পরীক্ষার সব প্রশ্নের উত্তর সংবলিত মেসেজ পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে বংশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ‘ক’ ইউনিটের পরীক্ষা চলাকালে লালমাটিয়া কলেজ থেকে ঘড়িতে স্থাপিত একটি যন্ত্রসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর। কিন্তু সেসব মামলার অগ্রগতি কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশাসন বা তিনি আর অবহিত নন।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বিভিন্ন পদ্ধতিতে জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়ছে চক্রগুলো। কোটি কোটি টাকার হাতছানি তাদের এসব অপকর্মে লিপ্ত হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি কিংবা প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনাতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, তাদের মধ্যে কতজনের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয় কিংবা তাদের কতজন শাস্তি পায়?
এ বছর ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এবার আরও অভিনব পন্থায়। সুদূর চীন থেকে বিশেষভাবে আমদানি করা ঘড়ির মাধ্যমে! গত ২০-২১ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ জালিয়াতিতে জড়িত ১১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে দুদক কর্মকর্তা, ছাত্রলীগ কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, তারা চীন থেকে বিশেষ পদ্ধতির দেড় শতাধিক ঘড়ি নিয়ে আসেন। সেসব ঘড়ির মাধ্যমে উত্তর পাঠিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, এবার কী হবে? এই আটককৃতদের কি ছেড়ে দেয়া হবে কিংবা তাদের পরিণতি কি হবে? দেড় শতাধিক ঘড়ির মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রত্যেক ভর্তিচ্ছুই কি টিকে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে? যারা দিনরাত পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন দেখেছিল মৃত্যু হবে সেসব স্বপ্নের?
প্রক্টর অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবছর ভর্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পরীক্ষায় টিকে যাওয়া অভিযুক্তরা হলেনÑ খান জাহান আলী (৪৮তম), নাজমুল আরেফিন (৯ম), মেহেদী হাসান (৫০তম)। বাকি দুজন মেধা তালিকায় ১৫০ এর মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেলেও তাদের নাম জানা সম্ভব হয়নি।
নাম উল্লিখিত তিনজনের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খুব বেশি ভাল না হলেও ভর্তি পরীক্ষায় তারা আশ্চর্যজনকভাবে সর্বাধিক নম্বরপ্রাপ্তদের তালিকায় স্থান করে নেন। এদের মধ্যে খান জাহান আলী ভর্তি পরীক্ষার ১২০ নম্বরের মধ্যে পান ৯০ দশমিক ৩৬। নাজমুল ৯০.৯০ এবং মেহেদী ৯৩.৬০ নম্বর অর্জন করেন। কিন্তু তাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট মিলিয়ে ৮০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছেন ৬০ এর কিছু বেশি। যেখানে দুটো পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়ে ৮০ তে ৮০ পেয়েও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি সেখানে এই অভাবনীয় ফল সন্দেহের দাবি রাখে। অভিযুক্তরা ছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় কেউ ৯০-এর উপর নম্বর পাননি। তাছাড়া প্রত্যেকেই ইংরেজীতে ৩০ নম্বরের মধ্যে সাড়ে ২৮ ও সাধারণ জ্ঞানে সমান সমান নম্বর পেয়েছেন।
তাদের সন্দেহের আরেকটি কারণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী বলেন, গত ২১ অক্টোবর ডিজিটাল জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জালিয়াত চক্রের ১১ জনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য খতিয়ে দেখে এই ৫ জনকে শনাক্ত করা হয়। তিনি আরও বলেন, আটককৃতদের একজনের আপন ছোট ভাই ও গ্রাম সম্পর্কিত এক ছোট ভাই এ পরীক্ষায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভর্তি হয়েছেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সহিদ আকতার হোসাইন বলেন, এই ৫ জনের ভর্তির পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.