বৈষম্যের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে, ফল ভাল করেছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা- প্রাথমিক ও জেএসসি পরীক্ষা by বিভাষ বাড়ৈ

যেকোন পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈষম্যের চিত্র। আর এ ক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থান থাকে সব সময়েই অনেক পেছনে।
কিন্তু এবার দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলে পাওয়া গেল ব্যতিক্রমী এক চিত্র। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দেশের ৩৯টি উপজেলায় একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থীও ফেল করেনি। আলো ছড়িয়েছে ৩৯টি উপজেলার শিশু শিক্ষার্থীরা। যেখানে পাস করেছে একশত ভাগ শিশু। কেবল তাই নয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা বোর্ডের ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়ও ফেল করেনি ৪৩টি উপজেলার কোন শিক্ষার্থী। প্রাথমিক শিক্ষার ফলের এই চিত্রকে শহর গ্রামের বৈষম্য নিরসন হয়ে গেছে বলে দাবি না করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার এই চিত্র ইতিবাচক।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিনামূল্যের পাঠ্য বই বিতরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পড়ালেখা করা এবং পরীক্ষায় পাস না করলে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হওয়া যাবে না এমন চিন্তা থেকে পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃৃদ্ধি পাওয়া এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে। এখন শহরের মতো গ্রামের একটি শিশু ও তার পরিবারকে ভাবতে হচ্ছে পরীক্ষায় পাস না করলে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হওয়া যাবে না। তবে একই সঙ্গে বিষেশজ্ঞরা এও বলছেন, তবে এই ‘ভাল ফলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। বৃহস্পতিবার একই দিনে প্রকাশ হয় দেশের সর্ববৃহৎ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফল। এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ৯৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯২ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও জেডিসিতে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ সালে প্রাথমিক সমপানীতে ৯২ দশমিক ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এ পরীক্ষায় গত বছর পাসের হার ছিল ৯৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। দুই বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক সমাপনীতে পাসের হার বেড়েছে পাঁচ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। ২০১০ সালে ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীতে ৮৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। দুই বছরের ব্যবধানে এ পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে আট দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে জেএসসিতে ২০১০ সালে ৭১ দশমিক ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। ২০১১ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। দুই বছরের ব্যবধানে পাসের হার বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর জেডিসিতে ২০১০ সালে ৮১ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৮৮ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে। এ পরীক্ষায়ও গত দুই বছরে পাসের হার বেড়েছে নয় দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু এ পরীক্ষা ছাড়াও এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই যে বিষয়টি হতাশার কারণ হয়ে সামনে চলে আসে সেটি হলো, গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈষম্যের চিত্র। এ ক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থান থাকে সব সময়েই অনেক পেছনে। প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল ফল করা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার মধ্যে থাকে রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের কিছু নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এবারের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রাথকি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় একমাত্র জেলা হিসেবে শতভাগ পাসের গৌরব অর্জন করেছে লালমনিরহাট। তবে আলো ছড়িয়েছে ৩৯টি উপজেলার শিশু শিক্ষার্থীরা। এখানকার কোন শিশু পরীক্ষায় ফেল করেনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মোট ৩৯টি উপজলায় কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফেল করেনি। উপজেলাগুলো হচ্ছে- যশোরের কেশবপুর, ঝিকরগাছা, বাঘারপাড়া, শার্শা ও সদর, বাগেরহাটের কচুয়া, শরণখোলা, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, টঙ্গীবাড়ী, পুটয়াখালীর দুমকি, গলাচিপা, রাংগাবালি, পটুয়াখালী সদর, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, বরগুনার বামনা, বেতাগী, ও পাথরঘাটা, বরগুনা সদর, খুলনার দাকোপ, তেরখাদা, দিঘলিয়া, চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ, হাইমচর, ঝালকাঠির নলছিটি ও রাজাপুর, বগুড়ার শিবগঞ্জ, বরিশালের উজিরপুর, মেহেদীগঞ্জ, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট সদর, অদিতমারী, মৌলভীবাজারে জুরী, মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল এবং চাঁপাইনবাবগেঞ্জর নাচোল।
ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়ও ফেল করেনি ৪৩টি উপজেলার কোন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আছে- ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট, মতিঝিল, সূত্রাপুর, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, মতলব উত্তর, রাজশাহীর দুর্গাপুর, জয়পুরহাটের কালাই, খুলনা সদর, নওগাঁর নিয়ামতপুর, বদলগাছী, যশোরের শার্শা, মৌলভীবাজারের জুরী, পিরোজপুরের পিরোজপুর সদর, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, মৌলভীবাজারের রাজনগর, বগুড়ার গাবতলী, শিবগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, রাজশাহীর বাঘা, ঝিনাইদহের সদর, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, বরিশালের হিজলা, মেহেদীগঞ্জ, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, টাঙ্গাইলের বাসাইল, রাঙ্গামাটির বরকল, বাগেরহাটের শরণখোলা, মোল্লাহাট, পটুয়াখালীর রাংগাবালি, গলাচিপা, ঝালকাঠির রাজাপুর, ভোলার তজুমুদ্দিন, বরগুনার পাথরঘাটা, সাতক্ষীরার দেবহাটা, বরগুনার বেতাগী, লালমনিরহাটের অদিতমারী এবং মানিকগঞ্জের হরিরামপুর। শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আবছারুল আমীন বললেন, এবার পরীক্ষাগুলোর সব সূচকেই ভাল করেছে শিক্ষার্থীরা। দুজনেই তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ফলের সব সূচকে ভাল করায় আমরা সকলে সন্তুষ্ট। বিনামূল্যে সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়া, নকলবিরোধী প্রচারণাসহ সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগ ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারেই পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার মানে উন্নতি ঘটেছে।

No comments

Powered by Blogger.