গুলের চিঠি কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত উত্তেজনা by বিকাশ দত্ত

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের চিঠিতে গোলাম আযমের ফাঁসি না দেয়ার অনুরোধে ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিনিধি দল আসা ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি দেখার পর দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রধান আইন কর্মকর্তা, সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী প্র্রসিকিউটরসহ সুশীল সমাজের নেতবৃন্দ এক বাক্যে বলেছেন, শুধু কূটনৈতিক শিষ্টার পরিপন্থী বা অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ নয়, এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সাবভৌমত্বের ওপর আঘাত।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট যা করেছে তা ধৃষ্টতার শামিল। কারণ বিচার হবে দেশের আইন অনুযায়ী। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে ডিজিটাল ষড়যন্ত্র চলছে। এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্রাদারহুডের পর এবার সৌদি আরব থেকে আরেকটি প্রতিনিধি দলের আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচাল করার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী দেশে বিদেশ যে বহুমাত্রিক অপতৎপরতা চালাচ্ছে তার সর্ব শেষ নমুনা হচ্ছে তুর্কী প্রেসিডেন্টের চিঠি। উল্লেখ্য, গত শতাব্দীতে বিশ্বের প্রথম গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছিল তুরস্ক। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তুরস্ক ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করেছে। তারাই আবার এখন বাংলাদেশের গণহত্যাকারীদের বিচার বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। আর জামায়াত যা করেছে তা হিটলারের চেয়েও বেশি অপরাধ। হিটলার ইহুদীদের হত্যা করেছে। আর জামায়াত এ দেশে হিন্দু-মুসলমানদের হত্যা করেছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, বিচার বন্ধ করার কথা কেউ বাংলাদেশকে বলেনি। শুক্রবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমসহ মানবতাবিরোধী মামলার আসামিদের মৃত্যুদ- না দিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল। জবাবে বাংলাদেশ জানিয়েছে, তুরস্কের এই অনুরোধ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেন। যা আঙ্কারা থেকে পাঠানো হয়। ২৩ ডিসেম্বর ওই চিঠি ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন।
বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিএনপি ও জামায়াতের ১৪ জনের বিচার চলছে। এর মধ্যে বিএনপির দুজন এবং জামায়াতে ইসলামীর ১২ জন নেতা রয়েছেন। যার মধ্যে আছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, হাজী মোবারক ও পটুয়াখালীর রুস্তম আলী। এদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিচার চলছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা এমএ আলীমের। এ ছাড়া তদন্তকারী সংস্থা ১১ অক্টোবর পলাতক দুই জামায়াত নেতা মোঃ আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন শাখায় জমা দিয়েছে। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, এ মাসের মধ্যেই এই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ফরমাল চার্জ হিসেবে জমা দেয়া হবে। এদিকে দুই আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য সিএভিতে রেখেছেন। এরা হলেনÑ জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ। সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় আাসামিপক্ষ তিনটি মামলা রি-ট্রায়ালের আবেদন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। গোলাম আযমের যুক্তিতর্ক আসামিপক্ষ শেষ করেছে। এখন সাঈদীর পক্ষে আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক করছে। এরপর প্রসিকিউশনপক্ষ শুনানি করবে।
বিচার যখন চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আামাদের দেশের আইনে যা হওয়ার তাই হবে। আইন অনুযায়ী বিচার হবে। তারা যে অনুরোধ করেছে সেটা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তবু আমি বলব, আদালত সার্বভৌম। রাষ্ট্র সার্বভৌম। তিনি আরও বলেন, জামায়াত স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না। বাংলাদেশকে কতখানি গ্রহণ করেছে তাদের আচরণ থেকেই বোঝা যায়।
বিচার প্রসঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যাকিং করা কর্মকা-ে সামান্যতম অনুকম্পা নেই। তারা শুধু বিচারকে সময়ক্ষেপণ করার জন্যই এটা করছে। এরা যা করেছে হিটলারের চেয়েও বড় অপরাধ করেছে। হিটলার যেমন ইহুদীদের হত্যা করেছে। আর জামায়াতের নেতারা হিন্দু-মুসলমানদের হত্যা করেছে। তারা হিন্দু না মুসলমান তা প্রমাণের জন্য পরনের কাপড় পর্যন্ত খুলে ফেলেছে। তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের চিঠির পর ২৪ ডিসেম্বর পর্যবেক্ষকের ছদ্মাবরণে তুরস্কের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট আইনজীবীর একটি প্রতিনিধি দল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান গেটে যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। তাঁরা ট্রাইব্যুনালের ভেতরে এলে এজলাস কক্ষে শর্তসাপেক্ষ প্রবেশ করতে দেয়া হয়। সেখানে প্রতিনিধি দল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ সময় আাসামিপক্ষের আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রতিনিধি দল কথাবার্তা বলেন। পরে জানা গেছে, ওই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য।
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের লেখা চিঠি নিয়ে ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ২৩ ডিসেম্বর তুর্কী ভাষায় (সঙ্গে ইংরেজী অনুবাদ) এক পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে যুদ্ধাপরাধে গোলাম আযমসহ যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাদের ক্ষমা করে দেয়ার আহ্বান জানান।
চিঠিতে গুল লিখেছেন, গোলাম আযমের বয়স ৯০ বছরের ওপরে এবং যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই প্রবীণ। তিনি গোলাম আযমসহ অভিযুক্ত অন্য সব জামায়াত নেতাকে মৃত্যুদ- থেকে রেহাই দেয়ার আহ্বান জানান। গুল আরও লেখেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিলে তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমানকে তলব করে বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে সেদেশের সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এটি কূটনৈতিক নীতিমালায় একটি অন্যায্য আবদার। ঢাকা এ বিষয়ে আঙ্কারার ওপর বেশ ক্ষুব্ধ। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের মতো দেশের এ ধরনের অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে সরাসরি সুপারিশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছে। সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ থেকে পিছিয়ে আসার কোন কারণ নেই। তা ছাড়া এখনও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারও শাস্তি আদালত ঘোষণা করেনি। কিন্তু রায় ঘোষণার আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এ ধরনের চিঠি লেখা বিচারকার্যক্রমকে ব্যাহত করার এক প্রকার চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, তুরস্কের কোন এখতিয়ার নেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার। তুরস্ক যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চিঠি দিয়ে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তারা সব রকম কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করেছে। তারাই গত শতাব্দীতে প্রথম গণহত্যা করে। ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করেছে। আমরা শুনেছি ট্রাইব্যুনালে ব্রাদারহুড এসেছিল। আবার এখন সৌদি আরব থেকে একটি প্রতিনিধি দল আসছে। তুরস্ক জানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে আর্মেনীয়রা গণত্যার বিচার দাবি করবে।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জনকণ্ঠকে বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তুরস্কের হস্তক্ষেপের কঠোর নিন্দা করা উচিত। হস্তক্ষেপমূলক বিষয়গুলো তীব্র প্রতিবাদ জানানো উচিত। ধিক্কারের সঙ্গে জানানো উচিত। স্বাধীন দেশের সঙ্গে আরেক স্বাধীন দেশের এ আচরণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ যা ধৃষ্টতার শামিল।
প্রতিনিধি দল আসার পরই ২৫ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের ভিসা সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে, সে বিশেষ ক্যাটাগরির পাসপোর্ট বাহকরা অন এ্যারাইভ্যাল ভিসা পান। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তারা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সঠিক কাজ নয়। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা এ ধরনের ভিসার প্রস্তাব দিলে চলতি বছরের মাঝামাঝি এটি অনুমোদন করে আঙ্কারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমাদের সঙ্গে বিশ্ব জনমত রয়েছে। আমাদের বিপক্ষে কিছু সংবাদমাধ্যম ও দু’একটা রাষ্ট্র কথা বলছে। কিন্তু এ দু’একটা রাষ্ট্র তো কখনও বলছে না বিচার বন্ধ কর।’ একটি সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কই একমাত্র দেশ, যে দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করেছেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আঙ্কারা সফরে গেছেন।’ এর অর্থ হলো দু’দেশের মধ্যে একটি পরিপূর্ণ কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
আঙ্কারার বাংলাদেশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এ প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাঁরা অন এ্যারাইভাল ভিসা নিয়েছেন। প্রতিনিধি দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যবেক্ষণ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও বিরোধী দলের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেছে। তারা তুর্কি সরকারের মদদপুষ্ট একটি এনজিও। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন তুরস্কের এক সাবেক প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া রয়েছেন সাবেক এমপি, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।
এর আগেও জামায়াতী আইনজীবীরা বিদেশ থেকে আইনজীবী আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনে নেই কোন বিদেশী আইনজীবী এদেশের আইনী লড়াই চালাতে পারবেন। এমন একটি বিষয় ২০১১ সালের ১৫ নবেম্বর চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ এমন একটি বিষয় ট্রাইব্যুনালের নজরে এনেছিলেন। যাঁরা বিদেশে জামায়াতের আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেন। তারই অংশ হিসেবে সেই তিন বিদেশী আইনজীবী স্টিভেন কে, টোবি ক্যাডম্যান ও জন ক্যামেগ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের অপসারণ চেয়ে তার কাছেই ই-মেইল করেন। এ বিষয়টি চীফ প্রসিকিউটর গোলম আরিফ টিপু ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন। ট্রাইব্যুনাল এর বিরুদ্ধে আদেশ দিয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, তারা বিদেশী আইনজীবী হিসেবে ই-মেইল করায় আচরণ লঙ্ঘন করেছেন। এটা তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ। এ বিষয়টি লন্ডনের বার স্টান্ডার্ড বোর্ডের নজরে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ব্যারিস্টার মেজবাহউদ্দিন আহম্মেদকে নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ডেপুটি রেজিস্ট্রার ব্যারিস্টার মেজবাহউদ্দিন আহেম্মেদ তাদের কাছে চিঠি পাঠান।
সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ.ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৈৗম রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বহিঃরাষ্ট্রের যে কোন কারোর জন্য কূটনৈতিকশিষ্টাচার পরিপন্থী। এছাড়া তাদের আবদারের বিষয়টি বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে চলমান বিচার কার্যক্রমের হস্তক্ষেপের শামিল। আইনের শাসন রক্ষায় অপরাধীদের বিচার করার শাস্তি দেয়া বা অন্য কোনরূপ সিদ্ধান্ত বিষয়ে তাদের আবেদন অপরাধীকে বিচারের বাইরে রাখার কার্যক্রমের শামিল। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এ জাতীয় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শোনা যাচ্ছে অপরাধীরা বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। এ ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না, তাও তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, এখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ডিজিটাল ষড়যন্ত্র চলছে। সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও ই-মেইল হ্যাকিং-ই তার বড় প্রমাণ।
দীপু মনি ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, বিচার বন্ধ করার কথা কেউ বাংলাদেশকে বলেনি। শুক্রবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমসহ মানবতাবিরোধী মামলার আসামিদের মৃত্যুদ- না দিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল। জবাবে বাংলাদেশ জানিয়েছে, তুরস্কের এই অনুরোধ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। সকালে রাজধানীর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমনেসিয়ামে বাংলাদেশ তায়কোয়ানদো ফেডারেশনের এক অনুষ্ঠান শেষে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার জবাবে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের কথা কেউ বলেনি।
নির্মূল কমিটি ॥ তুরস্কের রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ গুল সম্প্রতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন গোলাম আযমকে মৃত্যুদ- না দেয়ার অনুরোধ করেছেন। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’
শুক্রবার সংগঠনের সভাপতি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানানো হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচাল করার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে-বিদেশে যে বহুমাত্রিক অপতৎপরতা চালাচ্ছে তার সর্বশেষ নমুনাÑ বিচারাধীন গোলাম আযমের মামলার রায় ও শাস্তি সম্পর্কে তুরস্কের আপত্তিকর মন্তব্য।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি তুরস্কের রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে মৃত্যুদ- না দেয়ার যে অনুরোধ জানিয়েছেন তা শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত বলে আমরা মনে করি।
প্রত্যেক দেশের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন ও সার্বভৌম। কোন দেশ অন্য দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারে না। যদি করে সেটা সেদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত বলে গণ্য করা হয়। গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণার আগেই তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা গণহত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি আদালতের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের শামিল, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা তুরস্কের রাষ্ট্রপতির এই নিন্দনীয় কাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করছি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, তুরস্কের রাষ্ট্রপতির মনে রাখা উচিত গত শতাব্দীতে বিশ্বের প্রথম গণহত্যার ঘটনা তুরস্ক ঘটিয়েছিল। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তুরস্ক ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করেছে। অদ্যাবধি যার বিচার হয়নি। গণহত্যার ভুক্তভোগী আর্মেনিয়ার মানুষ প্রায় এক শ’ বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এর বিচার দাবি করছে। শুধু তাই নয়, এখনও তুরস্ক নির্বিচারে কুর্দিদের হত্যা করছে। গণহত্যাকারীদের দেশ তুরস্ক অন্য দেশের গণহত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তির বিরুদ্ধে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিতে ঝোলানোর রেকর্ড তুরস্কের মতো অন্য কোন দেশের নেই। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ঢোকার জন্য তুরস্ক মৃত্যুদ-ের বিধান বিলোপ করলেও প্রধানমন্ত্রী এর্দোগান আবার মৃত্যুদ-ের পক্ষে জনমত গঠন করছেন। আমরা মনে করি বাংলাদেশ যেভাবে নিজস্ব আইন ও দেশীয় আদালতে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে তা সফল হলে গণহত্যার শিকার অন্যান্য দেশও অনুপ্রাণিত হয়ে এসব অপরাধের বিচারের উদ্যোগী হবে। তুরস্কের ভয় এখানেই।
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ গুলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের বিরোধিতা করে। যার দল মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য মৌলবাদী সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যারা মনে করে ইসলামের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা বৈধ। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তুরস্কসহ অন্য যে কোন দেশ যদি আমাদের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে তা মর্যাদা ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করুন এবং সব বাধা কঠোরভাবে মোকাবেলা করে দ্রত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করুন।
উদীচীর প্রতিবাদ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ গুলের করা আবেদনের নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সংগঠনটি মনে করে, তুরস্ক সরকারের এহেন আচরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের শামিল।
উদীচীর সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, তুরস্ক সরকারের এ অপতৎপরতার নিন্দা জানানো উচিত বাংলাদেশ সরকারের। একই সঙ্গে যথাযথ কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার বলেন, ‘দেশের জনগণের প্রাণের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে অনেকদিন ধরেই দেশে-বিদেশে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলে আসছে। তুরস্কের রাষ্ট্রপতির এ আবেদন সেই ষড়যন্ত্রেরই নির্লজ্জ বহির্প্রকাশ।’ এছাড়া তিনি সম্প্রতি ‘অন-এ্যারাইভাল’ ভিসার অনৈতিক ও বেআইনী ব্যবহারের মাধ্যমে তুরস্কের কয়েক আইনজীবী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঢুকে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যে আলোচনা করেছে, তারও তীব্র নিন্দা জানান।
অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সরকারসহ দেশের স্বাধীনতার পক্ষের সকল জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে উদীচী। একইসঙ্গে সংগঠনটি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী শক্তিকে বাঁচাতে দেশে-বিদেশে যে কোন অপতৎপরতা রুখতে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করে।

No comments

Powered by Blogger.