ফয়’স লেক বধ্যভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে

বিএনপি-জামায়াত আমলের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মের স্বাক্ষর হচ্ছে ফয়’স লেক সংলগ্ন কাঁঠালবাগান বধ্যভূমির বেশিরভাগ জায়গা একটি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের হাত থেকে দেশকে হানাদারমুক্ত করলেও মীরজাফরদের কারণে রাজাকারমুক্ত হয়নি বাংলাদেশ।
ফলে বধ্যভূমির জায়গাও বাণিজ্যিক ভূমিতে পরিণত হচ্ছে মুখোশ পরিবর্তনের মাধ্যমে। চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি ফয়’স লেক সংলগ্ন কাঁঠালবাগান বধ্যভূমি। জিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (জিবা)-এর বহুতল ভবন বাস্তবায়ন করতে বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলেই এ বধ্যভূমির জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধীরাই এ ভূমি জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলামের নামে বরাদ্দ দিতে সহায়তা করেছে। এদিকে, ভূমিদস্যুচক্র সরকার থেকে বিভিন্ন সময়ে লুফে নিচ্ছে বধ্যভূমির জায়গাসহ স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ। চট্টগ্রামে এমন ভূমি উদ্ধারে কোন সরকারী উদ্যোগ নেই। সেই সঙ্গে রয়েছে জেলা প্রশাসনসহ পুলিশ প্রশাসনের আর্থিক ও দেশবিরোধী দুর্বলতা।
রাজাকারদের চক্রান্তেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে না থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। স্বাধীনতা রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো সরকারী উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের বৃহদায়তন বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও মুষ্টিমেয় কিছু স্মৃতিস্তম্ভ এখনও নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ফলে অরক্ষিত রয়ে গেছে স্বাধীনতাকামী শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো।
জাতিকে পাকিদের শোষণমুক্ত করতে ও দেশ মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসের মধ্য দিয়ে বাঙালী ফিরে পেয়েছে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এদেশ বাংলাদেশ। আর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছেন শান্তির প্রতীক ‘জুলিও কুরী’ পদক। এ পদক প্রাপ্তির পর তিনি দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন ‘এ পুরস্কার আমার একার জন্য নয়, যে লাখো শহীদের রক্তে আজ বাংলাদেশ মুক্ত, স্বাধীন এ সম্মান তাদেরই দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বর্বর পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছে তারই পুরস্কার স্বরূপ এসেছে ‘জুলিও কুরী’ শান্তি পুরস্কার’।
পাকিদের হত্যাযজ্ঞের করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ঐ সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী একেএম আফসার উদ্দিন ‘উন্মেষ’ নামক একটি ছোট্ট সঙ্কলনে উল্লেখ করেছেন স্মৃতির কথা। ছোট্ট এ সঙ্কলনটি মোঃ শহীদুল ইসলাম সম্পাদিত ও পাহাড়তলী শাখা থেকে সূর্যমুখী কাফেলা কর্তৃক নিবেদিত এ উন্মেষ প্রবন্ধটি। আফসার উদ্দিন তার লেখায় তুলে ধরেছেন-একাত্তর সালের ১০ নবেম্বর সেদিন ছিল ২০ রমজান। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফজরের নামাজের পর আকবর শাহ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হতেই পাক হানাদাররা ওই মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ বেশ কয়েক মুসল্লিকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিজেকে আড়াল করে আরও ৪ জনসহ ফয়’স সংলগ্ন কাঁঠালবাগানের বধ্যভূমির কাছে গিয়েছিলেন। হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে তার লেখায়। ঐ দিন পাক হানাদাররা শুধু মসজিদ থেকেই নয়, বাসা বাড়ি থেকে ঘুমন্ত তরুণ যুবকদের টেনে হিঁচড়ে যেমন নিয়ে যায় জল্লাদখানায় তেমনি পাহাড়তলী স্টেশনে আসা ট্রেন থেকে অনেক যাত্রীকে নিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। ফলে জল্লাদখানার পার্শ্ববর্তী সরু“ খালটির পানি রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
এ জল্লাদখানায় বাঙালী নিধনযজ্ঞের সাক্ষী লক্ষ্মীপুরের গোফরান ভুঁইয়া বিভিন্ন সময়ে জনকণ্ঠকে বলেছেন, আকবর শাহ মসজিদের পাশে থাকা একটি দোকানে মুদি ব্যবসা করতেন তিনি। ’৭১-এর ১০ নবেম্বর সকাল ৬টার দিকে পাক হানাদারদের কয়েক দোসর তাকে পাহাড়ের পাশে ৩/৪টি লাশ পড়ে আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ঐ জল্লাদখানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের হাত থেকে জল্লাদখানার পাশেই থাকা খাল সংলগ্ন সড়কের কালভার্টের নিচে ঝাঁপ দিয়ে পাকিদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। তখন ছিল ভরা বর্ষা। কালভাটের নিচে একটি পাটাতন ধরে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন খালের অথৈই পানিতে। এ সময় তিনি দূর থেকে দেখেছেন পাকিদের হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র। তখন তিনি ছিলেন ২৯ বছরের টগবগে যুবক।
চট্টগ্রামে সবচেয়ে বৃহৎ বধ্যভূমি হচ্ছে পাহাড়তলীর ফয়’স লেক সংলগ্ন কাঁঠালবাগান বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১০ নবেম্বর এ বধ্যভূমিতে পাক পশুদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে এলাকাবাসী হারিয়েছে ময়না, মানিক, সফিসহ শত শত তরুণ, যুবক ও প্রবীণদের। আজও মাটি খুঁড়লে পাওয়া যাবে শহীদদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। নীরবে কেঁদে যাচ্ছে এসব আত্মত্যাগী প্রাণ। বিধ্বস্ত বাংলার ৩০ লাখ শহীদের মাঝে দেশব্যাপী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে দ্বীপশিখা হয়ে জ্বলবে এ এলাকার যুদ্ধাহত শহীদরাও। কিন্তু ভূমিদস্যুদের থাবার কারণে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে এ বিশাল বধ্যভূমি। প্রায় ২ একর জায়গার বধ্যভূমি শোষকদের দখলে চলে গেছে বেশিরভাগই। সামান্য একটু জায়গায় প্রজন্ম ’৭১ এর অনুপ্রেরণায় সরকারী উদ্যোগে এ বধ্যভূমিতে ছোট্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। কিন্তু বৃহদায়তন অট্টালিকার কারণে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত তৃতীয় প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলা স্মৃতিস্তম্ভ। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সেই সুবিশাল খালটি। যে খালের মধ্যে পাকিরা বাঙালীদের হত্যার পর ঐ খালের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
অপরদিকে, জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের পক্ষ থেকে ফয়স লেকস্থ বধ্যভূমির জায়গায় নির্মাণ শেষের অপেক্ষায় রয়েছে ‘জিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিবা) ভবন। তবে একই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নামমাত্র মূল্যে রেলের জায়গা লিজ নিয়ে ইউনির্ভাসিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি) গড়ে তুলেছেন। এরই গা ঘেঁষে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এসে ঐ সরকারকে খুশি রাখতে বধ্যভূমির জায়গা দখলে নিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত আছে ‘জিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিবা) ভবন। একই সময়ে চট্টগ্রাম টেলিভিশন ভবনের পূর্ব পাশে রেলের আরও একটি সুবিশাল জায়গা লিজ নিয়ে বহুতল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তবে বধ্যভূমির জায়গা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দখলে নেয়ায় শুধু বিতর্কের জন্মই হয়নি, বিভিন্ন সময়ে শহীদ পরিবারের মানববন্ধন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ধিক্কারের সম্মুখীন হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, ৯০-এর দশকে এসে ঐ এলাকার যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তানীদের আবাসস্থল পাঞ্জাবী লেনের নাম মুছে দিয়ে শহীদ লেন নামকরণ করা হলেও শহীদদের স্মৃতিফলক গড়ে তোলা পুলিশ বিট সংলগ্ন শহীদ মিনার থেকে নামফলক উপড়ে ফেলেছে একটি চক্র। শহীদ মিনার হেসেবে গড়ে তোলা স্তম্ভগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সেখানে প্রতিরাতেই জমে উঠে মাদকসেবীদের জমজমাট আড্ডা। সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। ফলে শহীদদের স্মৃতি ধূলিসাত হচ্ছে প্রতি কদমে কদমে।
Ñমাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.