অন্তিমে মানুষের প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের কাছেই by মুহম্মদ শফিকুর রহমান

আপনি আওয়ামী লীগ করেন কেন?’ মাঝে মধ্যে এ ধরনের কিছু অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! কী জবাব দেব এর? জবাব দেয়ার আগে প্রশ্নটা ভালভাবে বোঝা চাই তো? এটা কি কোন প্রশ্ন হলো? তবু কয়েকবার যে জবাবটি দিয়েছিলাম তা হলোÑ ‘আওয়ামী লীগের চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কোন দল পাচ্ছি না বলেই।’ তখন দেখি মুখ থেকে আর কথা বেরোয় না প্রশ্নকর্তার।
তিনি আশা করেছিলেন আমি লম্বা ফিরিস্তির একটা বক্তৃতা দেব এবং তিনিও আরও কিছু বেয়াড়া আনাড়ি প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করতে পারবেন। আমার জবাবে সন্তুষ্ট না হলেও আর বাড়ায় না, কারণ আঁচলের সাপটি বেরিয়ে আসবে। এই যেমন ২৭ ডিসেম্বরের জনকণ্ঠের প্রথম পাতার ছবিটার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে খালেদা জিয়ার জনসংযোগ কর্মসূচী পালনকালে পেছনে-সামনে-আশপাশে যত ব্যানার দৃশ্যমান সবই তার আঁচলের সাপ জামায়াত-শিবিরের (বিচারাধীন) যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকা-সাঈদীদের ছবি সংবলিত এবং একটি চ্যানেলে দেখলাম মাথায় ব্যান্ড বাঁধা শিবিরের তরুণরা বলছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেবে। গোলামদের বের করে আনবে।
ধন্যবাদ জনকণ্ঠকে তাঁরা ওইদিনের সঠিক ছবিটি প্রথম পাতায় ছেপেছেন। জনকণ্ঠকে ধন্যবাদটা এ জন্য যে, ডেইলি স্টার, প্রথম আলোও খালেদা জিয়ার গণসংযোগের ছবি ছেপেছে, তবে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গীদের আড়াল করে, ঠিক যেভাবে খালেদা জিয়া তাদের আঁচলে লুকিয়ে আড়াল করে রেখেছেন সময় মতো কাজে লাগাবার জন্য। কিন্তু তাঁর ভবিতব্য বলে ওই সাপই তাঁকে ব্যবহার করে চলেছে এবং তিনিও ব্যবহৃত হতে হতে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন! একদিন হয়ত এমন ছোবল মারবে যা সামলাবার মতো দলের কাউকে খুঁজে পাবেন না এবং সেদিন আর বেশি দূরেও নয়।
কেন আওয়ামী লীগ করি?
এ জন্যই আওয়ামী লীগ করি।
আমার এ লেখা যখন ছাপার অক্ষরে বেরোবে তখন আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন চলছে। কাজেই আওয়ামী লীগের ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে মোটামুটি এই দলটিকে দেখে আসছি। তারই আলোকে কিছু আলোচনা করব।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, প্রয়োজন ও সময়মতো কাউন্সিল করে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছে এবং আমিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে গৌরবের অংশীদার।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি মানুষের সেবকদের দল।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি দেশের সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন করে (খালেদা জিয়ার মতো বলে না যত উন্নয়ন সব বিএনপির আমলে হয়েছে, কিন্তু কোন্ উন্নয়নটি হয়েছে সুনির্দিষ্ট করে একটির নামও বলতে পারে না)।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এ লেখাটা যখন লিখছি তখন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা বনানী ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করছেন, নির্ধারিত সময়ের ৬ মাস আগেই।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এটি জাতির জনকের হত্যার বিচার করেছে, রায় কার্যকর করেছে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, ওয়াদা আনুযায়ী যাত্রাবাড়ী, এয়ারপোর্টে রোডে আরও বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভারের কাজ সম্পন্ন করার পথে। পদ্মা সেতু করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটি ক্ষমতায় এলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।
ষ আওয়ামী লীগ এ জন্য যে, দলটি ক্ষমতায় এলে গ্যাস-বিদ্যুত পরিস্থিতির উন্নতি হয় (খালেদা জিয়ার আমলের মতো মোমবাতি জ্বালিয়ে বাচ্চাদের পরীক্ষা দিতে হয়নি, হচ্ছে না বা বছর শেষ হয় তবু বাচ্চাদের হাতে বই যায় না)।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটি জাতীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের মোকাবেলা করে ঠিক মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মতো সমুদ্র বিজয় করে প্রমাণ করেছে এটি জনগণের স্বার্থরক্ষার একমাত্র দল।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এ দল ক্ষমতায় থাকলে জিডিপি ৬+... হয়।
ষআওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এ অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান ৫-এর মধ্যে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটি আগের বার ক্ষমতায় থাকাকালে (১৯৯৬-২০০১) গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলটি টেবিলে বসে চট্টগ্রামের পাহাড়ী-আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানে শান্তি চুক্তি করতে পারে এবং মিলিটারি সমাধানের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান অর্থাৎ অস্ত্র সমর্পণ করাতে পারে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সফল মোকাবেলার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মডেল হয়েছে। হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখে (যে বন্যায় দেশের ৭০% ভূমি ৯০ দিন পানির নিচে ছিল এবং ধান-পাট-রবিশস্য সব ফসল পচে গিয়েছিল এবং বন্যার পরে এমনভাবে পদক্ষেপ নেয়া হয় যে, পরের ফসলটিও বাম্পার হয়, পুরো সময়টাতেই বাম্পার ফলন হয়)।
ষ আওয়ামী লীগ এ জন্য যে, শেখ হাসিনার সরকার আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, দলের সরকারটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে জানে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, লক্ষাধিক টাকা মূল্যের মোবাইল ফোন ৪-৫ হাজার টাকায় নামাতে পারে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, এমন সাফল্যের ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাবে না বলে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন থেকে যত অর্জন সবই জাতির জনকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই করেছে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, জাতির জনকের হত্যার পর তাঁরই কন্যা বর্তমান দলের সভাপতি ও দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই সব অর্জন এসেছে বলে।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, শেখ হাসিনা কেবল বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণে এমএ ফাইনাল পরীক্ষা না দিতে পারলেও প্রাচ্যের অক্সপোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্র্যাজুয়েট’ সন্তানদের ব্যবসায় না নামিয়ে হার্ভার্ড, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অপর কন্যা শেখ রেহানার সন্তানরাও প্রতীচ্যের অক্সফোর্ড এডুকেটেড।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, বিএনপি নেত্রী যখন ক্যান্টনমেন্টের অবৈধ দখলের বাড়ির জন্য কাঁদেন, রাস্তায় আন্দোলন করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর দুকন্যা ধানম-ি ও টঙ্গীপাড়ার বাড়ি জনগণকে দান করেন।
ষ আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, শেখ হাসিনা পিতার মতোই সাহসী এবং দেশকে ভালবাসেন, মানুষকে ভালবাসেন, যিনি সরকার পরিচালনা করেন সেবক হিসেবেÑ শাসক হিসেবে নয়।
* সর্বোপরি আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, পিতার মতোই শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখতে জানেন, স্বপ্ন দেখাতে জানেন, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে জানেন।
* আওয়ামী লীগ করি এ জন্য যে, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন এবং রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও তাদের সহযোগীদের ঘৃণা করেন।
* এবং এ জন্য যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে আমরা নিরাপদ জীবনের স্বাদ পাই।
আওয়ামী লীগ না করার জন্য যে নেগেটিভ দিক একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়, বরং আছে। তবে নেগেটিভের চেয়ে পজিটিভ দিক অনেক অনেক গুণ বেশি। কারণ দলটির জন্মই হয়েছিল মানুষের মৌলিক-মানবাধিকারের লড়াইয়ের ময়দান থেকে। কোন সেনা ছাউনি বা কাশিমবাজার কুঠি থেকে এর জন্ম হয়নি। যেমন সেনা ছাউনিতে বসে ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে মিলিটারি জিয়া কয়েকটি রাজনীতির উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বিএনপি নামক দলটি গঠন করেছিলেন বলেই আজ দেশে এত সঙ্কট আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। জিয়া দল গঠন করার সময় বলেছিলেন, ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরবং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঃযব ঢ়ড়ষরঃরপরধহং (আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব)। সত্যি সত্যি দেশে আজ রাজনীতি কঠিন হয়ে আছে এবং এর জন্য এককভাবে দায়ী জিয়া। বিশেষ করে চধৎষরধসবহঃধৎু ঢ়ড়ষরঃরপং (সংসদীয় রাজনীতি) এমন কঠিন, ফরৎঃু ধহফ বীঢ়বহংরাব করে তোলা হয়েছে যে, একজন সৎ, সুশিক্ষিত, সুদক্ষ, দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি করা অসম্ভব হয়ে গেছে অর্থাৎ জিয়ার পলিটিশিয়ান কেনা-বেচার রাজনীতির কারণে নির্বাচন করা ভাল মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।
অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না।
জাতি হিসেবে এবং আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে প্রতিটি সঙ্কট মোকাবেলা করে যখনই এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে তখনই জিয়ার ফরভভরপঁষঃ পরিস্থিতি সামনে চলে আসে। এই ফরভভরপঁষঃ ংরঃঁধঃরড়হ কখনও আসে সামরিক পোশাক পরে কখনও তথাকথিত কেয়ারটেকারের কুৎসিত চেহারা নিয়ে। তারপরও আওয়ামী লীগ সব কিছু মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে মিলিটারি পার্টিকে, মোকাবেলা করতে হচ্ছে তথাকথিত সু-শীল সমাজকে। মোকাবেলা করতে হচ্ছে দেশী-বিদেশী মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদকে এবং সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, দলটি সত্যিকার অর্থেই মানুষের বাক, ব্যক্তি, মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাস করে, চর্চা করে, সে দলটিকেই সবচেয়ে বেশি মোকাবেলা করতে হয় গণমাধ্যমকে। কারণ রাজনীতি যেমন টাকাওয়ালা লুটেরাদের হাতে চলে যাচ্ছে তেমনই সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলোও চলে যাচ্ছে লুটেরাদের হাতে, বলা যায় চলেই গেছে। পেশাদার সাংবাদিকরা সেখানে অসহায় (দু-একজন বাদে), সবাই নিহায়ত পেটের দায়ে চাকরি করতে হয় তাই সাংবাদিক। এই বাংলাদেশে এমন টিভি চ্যানেলও আছে যাতে টকশোর নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আওয়ামী লীগের বিষোদ্গার করা হচ্ছে, ‘জনতার কথা,’ ‘মানুষের কথা’ ইত্যাদি নাম দিয়ে ইটিভি নামক চ্যানেলে একটি সাক্ষাতকারভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, যাতে মনে হবে বাংলাদেশে একজনও আওয়ামী লীগ সমর্থক বাকি নেই। সবই বিরোধী। আবার এমনও আছেন যিনি চিরকাল সব সরকারের সুবিধা নিয়েছেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের, তিনি বা তাঁরাও মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জন্য। ক’দিন আগে একটি চ্যানেলে দেখলাম আমাদের সাংবাদিকতা পেশার সবচেয়ে প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবিএম মূসা বা সবার মূসা ভাই দুনেত্রী থেকে ‘মুক্তি’ চাইছেন। এক সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার মুখেও একই সুর। দুনেত্রী থেকে মুক্তি চাওয়া মানে তাঁরা তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান চাইছেন। সেদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে আওয়ামী লীগ প্রথম শক্তি, বিএনপি দ্বিতীয় শক্তি, তৃতীয় শক্তি কে? উত্তর সোজা- হয় মিলিটারি নয়ত সাম্প্রদায়িক জঙ্গী জামায়াত-শিবির। দেশের বামপন্থী দলগুলোও তৃতীয় শক্তি হতে পারত এবং তা হলেই আওয়ামী লীগের সত্যিকার বিকল্প হতে পারত, কিন্তু বামরা এত বেশি বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে আদর্শগত সামান্য পার্থক্যও দলীয় বিভক্তি যেখানে, সেখানে অদূরভবিষ্যতে বামদের কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। আর সে সুযোগ নিয়ে মূসা ভাইরা জঙ্গী বা জংলী শাসনের পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন। আরেকটি কথা মূসা ভাইদের টার্গেট মূলত এক নেত্রী (শেখ হাসিনা), কিন্তু শরমের কারণে দুজনকে জড়ানো হচ্ছে। নইলে অপর নেত্রী (খালেদা জিয়া) তাঁদের কাছে অপ্রিয় নয় বলেই জানি।
আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে মানুষের মৌলিক-গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ের মধ্যে, ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনের মাঝে। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং এক বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আজকের আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। এ দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন সেদিনের তরুণ ছাত্র ও যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট এবং ভারত ভাগ হলে ওই বছরই ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন একদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলন চলছিল এবং তিনি তাতে যোগ দেন ও নেতৃত্ব দেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং কারারুদ্ধ হন। সেই থেকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৪৮ সালের ভাষাআন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ’৫৬-এর মার্শাল লবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন; ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় কিন্তু পাকি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে বিশ্ব ইতিহাসের নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন; ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বান ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং বঙ্গবন্ধুর নামে ও নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়; স্বাধীনতাউত্তরকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, ’৭৩-এর নির্বাচন ও বাংলাদেশের যুগান্তকারী গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন; এমনিভাবে সব সঙ্কট কাটিয়ে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই বঙ্গবন্ধু ও ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা কিছুটা হলেও সফল হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াতে খুব সময় লাগেনি। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করার পর সে বছরই ১৭ মে তিনি সাড়ে ৬ বছরের প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে এলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ তাঁকে বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত স্বাগত জানায় এবং আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর থেকে দল আবার সংগঠিত হাতে থাকে এবং ২১ বছর পর পুনরায় ক্ষমতায় আসে। বর্তমানে ৬৪ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হচ্ছে। এই কাউন্সিলকে কেন্দ্র করেই আমার এই সংক্ষিপ্ত রচনার প্রয়াস। আর যে কোন প্রয়াসে সবলতা-দুর্বলতা দুই-ই থাকতে হয়। সেদিক থেকে প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে একটি থানার সংগঠনের চিত্র তুলে ধরতে চাই।
আওয়ামী লীগের প্রথম দিকে মহকুমা, জেলা, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের প্রধান পেশা ছিল আইন ব্যবসা অথবা দলের ভাতা এবং ইউনিয়ন, থানা পর্যায়ে প্রধানত শিক্ষকতা। এখন কার কত বেশি টাকা আছে সেই হবে নেতা। শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে নিচের দিকে খুব কম নেতাই আছেন যাঁরা ব্যাংক বানানোর লোভ সামলাতে পারেন। মনে হয় সকল শ্রম ও ত্যাগ একা শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেন না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে চাঁদপুর জেলা ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সংগঠনের চিত্র। অনুসন্ধান করলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। সরকারের টিআর, কাবিখার চাল, গম বা খাসজমিও লোভনীয় ব্যাপার। ফরিদগঞ্জে এটি ওপেনসিক্রেট এবং এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাকার। তবে এসব লোভনীয় বস্তু হাসিলে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সম্প্রতি একজন মন্ত্রীর ডিও দিয়ে টঘঙ-কে এক বছরের মাথায় খাগড়াছড়ি ও অঈ ষধঁফ-কে ৭ মাসের মাথায় বান্দরবান বদলি করা হয়েছে। দুজনের গায়েই আওয়ামী লীগবিরোধী লেভেল লাগানো হয়েছে। অথচ প্রথম জন বৃহত্তর কুমিল্লার একটি আসন থেকে বার বার নির্বাচিত এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতার ভাতিজা, দ্বিতীয়জন সিলেটের একটি আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি ও সাবেক ডাকসু ভিপির ভাগ্নে। তারা দুজনই ছাত্রজীবনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনের সমর্থক ছিলেন। জেলার শীর্ষ নেতার উচ্চাভিলাষী ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ৭ বছর ফরিদগঞ্জ উপজেলায় কোন কমিটি নেই। চতুর্থবারের মতো কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে সম্প্রতি তৃণমূলের বাধার মুখে বিপুলসংখ্যক পুলিশের বেষ্টনীতে কোথাও সুপারি বাগানে বসে, কোথাও ঘরে বসে ইউনিয়নের তথাকথিত কমিটি গঠন করে গত ২৭ অক্টোবর সামান্যসংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে এক সম্মেলনের নাটক করা এবং একটি পকেট কমিটি গঠন করা হয়। চলমান কাউন্সিলের অভিজ্ঞতায় এসব বিষয় দেখা দরকার।
ঢাকা, ২৮ ডিসেম্বর
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.