শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরবিদায় জানানো হলো সোহরাব হোসেনকে

গানের পাখি সোহরাব হোসেন চিরদিনের, চিরকালের ও সকলের। সঙ্গীতের সুর ও বাঙালীর মননে তিনি সর্বজনীনÑ এ কথাগুলো লেখা ছিল শোক বইয়ের এক পাতায়।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পী ও শিক্ষক সোহরাব হোসেনের শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে ছিল সে শোকবই। আর সেখানে এমন হৃদয়ছোঁয়া শোকগাথা লিখেছিলেন আব্দুল মান্নান নামের এক অনুরাগী। এই সঙ্গীতগুরুর বিদায়যাত্রায় এমন অন্তরস্পর্শী কথামালা লিখেছিলেন আরও অনেকেই। দেশের সঙ্গীতের এই দীপশিখাকে নয়নঝরা জল, ফুলেল ভালবাসা ও শোকগাথায় চিরবিদায় জানিয়েছেন সর্বসাধারণ। পৌষের সকালে প্রথমে ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন এবং পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় এই সঙ্গীতজ্ঞকে। এরপর বাদ জুমা তাঁর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসার পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সব শেষে বেলা তিনটার দিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শুক্রবার সকাল সাতটায় সোহরাব হোসেনের মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের হিমাগার থেকে বের করা হয়। এরপর সাড়ে আটটার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায়। মরদেহ সেখানে পৌঁছলে বেদনাবিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ঝরে পড়ে স্বজনদের চোখের জল। ধ্বনিত হয় প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথাতুর হাহাকার। সকাল দশটার শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাব হোসেনের মনের যতেœ গড়া প্রিয় সংগঠন ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন প্রাঙ্গণে। এখানে তিনি অর্ধশতাব্দী ধরে গানের শিক্ষা দিয়ে তৈরি করেছিলেন হাজারো শিল্পী। নজরুলের গানের শুদ্ধ সুর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সবার মাঝে। আর এই গানের মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রথমেই ছায়ানটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে উঠে আসে গান। হৃদয়চাপা বেদনায় সবাই এক সুরে গেয়ে ওঠে দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য/হে উদারনাথ। এরপর গাওয়া হয় জাগো অমৃত পিয়াসী চিত। গান শেষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করেন সবাই। নীরবতা শেষে ছায়ানটের পক্ষ থেকে সভাপতি সন্জীদা খাতুন, সহসভাপতি ডা. সারওয়ার আলী ও সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় অনেকের চোখে সঙ্গীতগুরুর চিরবিদায়ের বিষাদের ছায়া অশ্রু হয়ে চোখে ধরা দেয়। পনেরো মিনিটের এ শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বটি একই সঙ্গে আবেগঘন ও ব্যথাতুর।
ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন থেকে সোহরাব হোসেনের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। কালো-সোনালী রঙের গিলাপে ঢাকা কফিনটি রাখা হয় গগনশিরীষ গাছের নিচে। সেখানেই শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান সর্বসাধারণ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধায়নে এ শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বের আয়োজন করা হয়। সোহরাব হোসেনের প্রতি কণ্ঠশিল্পী, বাকশিল্পী, নাট্যশিল্পী, ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এ শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বের শুরুতেই সোহরাব হোসেনের কফিনে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ফজলুল হক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাঁর একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখর। এ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান সঙ্গীতজ্ঞ সুধীন দাস, শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খালিদ হোসেন, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, সৈয়দ আবদুল হাদী ও শাহীন সামাদসহ অনেকে।
প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল ইনস্টিটিউটের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম ও নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষে সভাপতি কামাল লোহানী ও সাধারণ সম্পাদক প্রবীর শিকদার, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পরিষদের পক্ষে সুজিত মোস্তফা, কুমিল্লা জেলা পরিষদের পক্ষে জেলা প্রশাসক ওমর ফারুক, শিল্পকলা একাডেমীর পক্ষে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও সচিব মনজুরুর রহমান, নজরুল সঙ্গীত সংস্থার পক্ষে খায়রুল আনাম শাকিল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষে সহসভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষে মহাপরিচালক ম. হামিদ, আওয়ামী লীগের পক্ষে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ ছাড়াও সাংগঠনিকভাবে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ছায়ানট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, জাতীয় প্রেসক্লাব, যুবলীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), চারুকণ্ঠ আবৃত্তি সংসদ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা ইত্যাদি।
দেশের সঙ্গীতে সোহরাব হোসেনের অবদান তুলে ধরে নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ছয় দশক ধরে তিনি নজরুল সঙ্গীতের শুদ্ধ চর্চা করে গেছেন। আর এই সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও নজরুল সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নজরুল সঙ্গীত সাধনার পথিকৃৎ ছিলেন এই শিল্পী। নিজেকে সুরের কাছে সপে দিয়েছিলেন। শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীত চর্চার মাধ্যমেই এই মহান শিল্পীর প্রতি আমাদের সম্মান জানাতে হবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় এই অঞ্চলের অনেক শিল্পী ভারতে চলে যান। তখন শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। এ সময় কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন সোহরাব হোসেন। সে শূন্যতাকে পূরণ করলেন তিনি। এই শিল্পী গানটাকে সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। বেতার থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে গান গেয়েছেন। তাঁর মতো এত মিষ্টি কণ্ঠ খুব কম শিল্পীর ছিল। আজ তিনি একটি যুগের প্রতিনিধি হিসেবে চলে গেলেন। সাতচল্লিশ সালে যে শূন্যতা তিনি পূরণ করেছিলেন, আজ বিদায়বেলায় আবারও সেই শূন্যতা সৃষ্টি হলো। তবে তাঁর দীক্ষা নেয়া শিল্পীদের মাধ্যমেই তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
রশীদ হায়দার বলেন, তিনি পরিণত বয়সে চলে গেলেও প্রকৃত অর্থে আমাদের ছেড়ে যাননি। তাঁর মতো বড় শিল্পীর মৃত্যু হয় না। কাজের মধ্যেই এমন গুণীরা বেঁচে থাকেন। নজরুলের গানের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীত চর্চার মাধ্যমেই স্মরণ করতে হবে তাঁকে।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, নজরুল সঙ্গীতের চর্চা ও প্রসারে অসামান্য অবদান রেখেছেন সোহরাব হোসেন। তাঁর এই অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত শিল্পীরা মনে রাখবে। যতদিন এদেশে নজরুল সঙ্গীত চর্চা হবে ততদিন তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরিত হবেন।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মাস দুয়েক আগে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। প্রায় আড়াই ঘণ্টার সেই সাক্ষাতকারে অসাধারণন একজন মানুষের পরিচয় পেয়েছিলাম। খুব বিনয়ী একজন মানুষ ছিলেন। আর তিনি গান শেখাতেন মনের আনন্দে। শুধু শেখানোর জন্য শেখাতেন না, বিশ্বাস ও অঙ্গীকার থেকে শেখাতেন। গাইতেন বিভোর হয়ে। তার মতো এত বড় শিল্পী ও শিক্ষক দেশে আর আছে বলে মনে হয় না। সঙ্গীতকে জীবনের আরাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন এই শিল্পী।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার ভোরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সোহরাব হোসেন। সুরের ভুবনে ছয় দশকের পথচলায় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন অসংখ্য শিল্পী।

No comments

Powered by Blogger.