বগুড়ার পাসপোর্ট কার্যালয় দালাল চক্রের কাছে জিম্মি by আনোয়ার পারভেজ

বদরুন আখতার পেশায় সরকারি চাকরিজীবী। চিকিৎসার জন্য সপরিবারে ভারত যাবেন। পরিবারের চার সদস্যের পাসপোর্ট লাগবে। এ জন্য কয়েক দিন আগে তিনি বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর বগুড়ার আঞ্চলিক কার্যালয়ে আবেদন জমা দিতে এসেছিলেন।
কার্যালয়ের ফটকে এসে কর্তব্যরত একজন আনসার সদস্যের কাছে তিনি জানতে চান আবেদন ফরম কীভাবে পাবেন! আনসার সদস্যের উত্তর, ‘আপা, আবেদন করে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সারা দিন দাঁড়িয়ে থেকেও আজ আবেদন ফরম জমা নাও হতে পারে। তার চেয়ে লোক ডেকে দিচ্ছি, তারাই সব কাজ করে দেবে, আপনাকে কিছুই করতে হবে না।’
একটু পর ওই আনসার সদস্য ডেকে দিলেন এক দালালকে। দালাল বলে, ‘আজ আবেদন করলে কালকেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট (মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ছবি ও আঙুলের ছাপ নেওয়ার ধাপ) হবে। এ জন্য পাসপোর্টপ্রতি দুই হাজার টাকা বকশিশ লাগবে। ঝামেলা ছাড়াই কয়েক দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাবেন। টাকা না দিলে আবেদন পূরণ করে লাইনে দাঁড়ান। ঘুরতে থাকেন। তিন মাসেও পাসপোর্ট হাতে পাবেন না।’
দালালের কথা শুনে লাইনের প্রতি নজর পড়ে বদরুন আখতারের। পাসপোর্টপ্রত্যাশী কয়েক শ লোক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে চারজনের পাসপোর্ট বাবদ আট হাজার টাকা তুলে দেন দালালের হাতে।
পাসপোর্ট করতে এসে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা থেকে আসা বদরুন আখতারের একার নয়, বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাসপোর্ট করতে আসা অনেকের। তাঁদের অভিযোগ, দালাল ছাড়া এ কার্যালয়ে পাসপোর্ট নিতে গেলে নানা রকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, পাসপোর্ট কার্যালয়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র। এই চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের।
দালাল চক্রের পাশাপাশি ‘গোপনীয় অনুসন্ধান প্রতিবেদন’ দিতে গিয়ে পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে পুলিশও মোটা অঙ্কের টাকা নেয়।
জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে টাকা লেনদেন ও দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে প্রায় সময় তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক জানান, পুলিশি গোপনীয় প্রতিবেদন প্রদানকালে কোনো টাকা নেওয়ার কথা নয়। পুলিশের কোনো সদস্য কারও কাছ থেকে এ কাজে টাকা নিলে বা দাবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ পাওয়া গেলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই সদর থানার এক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে জানা যায়, এখানে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ২০০ পাসপোর্ট ইস্যু ও হস্তান্তর করা হয়। জনবল কম হওয়ায় ভুক্তভোগীদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন। বর্তমানে বগুড়া কার্যালয়ে ১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এমআরপি শাখায় ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে আসা রুহুল আমীন অভিযোগ করেন, পাসপোর্ট কার্যালয়ের আনসার বাহিনীর সদস্যরাই বড় দালাল। পাসপোর্টপ্রতি এক হাজার টাকা না দিলে তাঁরা আবেদনই জমা নেন না।
আদমদীঘি উপজেলার লক্ষ্মীকোল গ্রামের আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘ছোট ভাই শাহীন আলমের জরুরি পাসপোর্ট করতে ১৯ নভেম্বর ছয় হাজার টাকা জমা দিই। ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা থাকলেও প্রায় দেড় মাসেও তা পাইনি।’
আনসারের কর্তব্যরত দলনেতা আরিফুল ইসলাম দালালদের সঙ্গে যোগসাজশ ও কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আনসার সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে দালালেরা টাকা আদায় করে। দালালদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এমআরপি শাখার কর্মকর্তা এ টি এম নূর আলম জানান, সঠিক কাগজপত্র থাকলে কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।
জানতে চাইলে ওই কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান হাওলাদার জানান, কার্যালয়ের বাইরে কোনো টাকা আদায় বা দালাল চক্রের তৎপরতা থাকতে পারে। তবে ভেতরে কোনো ধরনের টাকা আদায় বা কাউকে হয়রানি করা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.