চারদিক- ওঁরা আপনার পাশেই থাকবেন by খাদিজা ফাল্গুনী

কেউ ভাবেন, ওঁরা নিরাপত্তাকর্মী। কেউ জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা কি স্কুলে পড়েন?’ কেউ খুব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকেন। একপর্যায়ে এগিয়ে এসে বলেন, ‘একসময় আমিও রোভার স্কাউট ছিলাম। ভাই, কী যে ভালো লাগছে আপনাদের দেখে!’
প্রিয় পাঠক, পরিচয় কথায় কথায় বলেই ফেললাম অবশেষে। ওঁরা রোভার স্কাউট। যেকোনো সময় যেকোনো কাজে আপনি ওদের দেখতে পাবেন। ছেলেদের ছাইনীল শার্ট, তাতে নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট। একই রঙের কামিজের সঙ্গে মেয়েদের সালোয়ার, সঙ্গে ক্রস করা ওড়না নীল বেল্টে এঁটে নেওয়া। আর পোশাকের বিভিন্ন স্থানে রংবেরঙের ব্যাজ। ওদের এই পোশাক দেখে যা-ই ভাবুন না কেন, ওঁরা হাসিমুখেই আপনাকে সেবা দিয়ে যাবেন। কারণ, রোভার স্কাউটদের মূলমন্ত্রই সেবা। একুশের রাঙা প্রভাত কি বিজয় দিবসের কেতন ওড়ানো ডিসেম্বর—ওঁরা কাজ করেন দেশের আনাচ-কানাচে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। একবার যিনি স্কাউট, তিনি আজীবনের জন্যই স্কাউট।
এখন সেপ্টেম্বর মাস। পাঠক, মনে করিয়ে দিই আরেকবার, চলছে জাতীয় আয়কর মেলা ২০১২। ঢাকার বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবে সাত দিনের এই আয়োজনের ভাগীদার ১০০ জন রোভার স্কাউট। কাজ একটিই—নবীন-প্রবীণ করদাতাদের কর প্রদান-প্রক্রিয়াকে আরেকটু সহজ করে তোলা। আমাদের দেশে এখনো অচেনা এই উৎসবকে আরেকটু রাঙিয়ে তোলা। আর এতে রোভারদের প্রাপ্তি? ওই যে বললাম, ভালো লাগার কথা। অবশ্য মেলা থেকে রোভাররা শিখতেও পেরেছেন অনেক কিছু। নিজেরাই বললেন, প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ওঁরা কী কী পেয়েছেন।
রোভার সাইদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আগে কখনো কর নিয়ে ভাবিনি। এখন নিজেই অন্যদের কর দিতে উদ্বুদ্ধ করছি। আমিও কর দেব একদিন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক প্রাক্তন রোভার এখন প্রথম শ্রেণীর কর কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে। বুঝতে পারছি, স্কাউটিং মানেই বৃথা সময় কাটানো নয়।’ নূরুল ইসলামের ভাষায়, ‘সারা জীবন স্কাউটিং করেই কাটিয়ে দিলাম। এত বড় জাতীয় অনুষ্ঠানে সেবা দিতে পারা কি কম কথা! অনেক প্রবীণ করদাতা জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ বলেছেন। এ যে কী তৃপ্তি, বলে বোঝানো যাবে না।’ মাহবুবা বলেন, ‘২০১০ সালে আয়কর মেলায় কাজ করেছিলেন মাত্র ১০ জন রোভার। এবার আমরা কাজ করছি ১০০ জন। এটি আসলে পুরো বাংলাদেশের রোভারদের অর্জন।’ মেলায় যাঁরা কর জমা দিতে আসেন, তাঁদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আয়োজন। যেমন নতুন টিআইএন নেওয়া, আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ ও জমা দেওয়া, চালান তৈরি কিংবা ই-পেমেন্ট। অর্থাৎ আয়কর-সংক্রান্ত সব ধরনের সুবিধাই দিচ্ছে আয়কর মেলা। আর সেবাদানের সঙ্গে সঙ্গে রোভাররা শিখে নিচ্ছেন আয়করের আদ্যোপান্ত। সেই সঙ্গে কারও কারও মনে জাগছে কর কর্মকর্তা হওয়ার বাসনা। রোভার স্কাউটদের সর্বোচ্চ পদক পিআরএস-প্রাপ্ত দুই প্রেসিডেন্ট রোভার স্কাউট মো. শাহমনি জিকো ও শাহ শারমিন ইসলাম সে রকমই বললেন। দুজনেই কর বিভাগে কাজ করতে চান। তাই এখন থেকেই হাবভাব বুঝে নিচ্ছেন। এ কথা বলতে গিয়ে তাঁরা হেসে ফেললেন। আর একবাক্যে প্রশংসা করলেন কর কর্মকর্তাদের। এত মেধাবী তাঁরা, অথচ কী বিনয়ী। শিফটে কাজ না থাকলেও তাঁরা হেঁটে হেঁটে করদাতাদের সাহায্য করছেন। এয়ার অঞ্চলের রোভার ফাইজুল ও মামুন বলেন, ‘আয়কর কথাটি শুনলেই অনেকে আঁতকে ওঠেন। ভাবে, না-জানি কী ঝামেলার কাজ! অথচ সেই কাজটিই কতটা সহজ আর আনন্দময় হতে পারে, তা বোঝা যাবে কেবল আয়কর মেলায় এলেই। আয়করের ফরম এখন আমরাই পূরণ করতে পারি।’ ইডেন মহিলা কলেজ থেকে প্রথমবারের মতো আয়কর মেলায় কাজ করতে এসেছেন রোভার সাকি, শাম্মা, আয়েশা ও অনি। যে ব্যাপারটি তাঁদের মুগ্ধ করেছে, সেটি হলো এবারের মেলায় করদাতাদের ভিড়। তাঁরা জানালেন, অনেকেরই কর দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি। তবু তাঁরা মেলায় এসেছেন কর দেওয়া যাবে কি না তা জানতে।
অতিরিক্ত কর কমিশনার ও আয়কর মেলার সদস্যসচিব এম এম ফজলুল হক আয়কর মেলার আয়োজনে রোভারদের অংশগ্রহণের বিষয়ে বলেন, ‘সেবা রোভারদের সহজাত প্রবৃত্তি। স্কাউট প্রতিজ্ঞায় তারা উদ্বুদ্ধ, আইন তাদের অনুপ্রেরণা। দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি যেমন আয়কর, আয়কর মেলাকে তেমনি সতেজ করে রেখেছে স্বেচ্ছাসেবকেরাই।’
পাঠক, আমরা রোভার স্কাউটদের মতো করে দেশকে নিয়ে ভাবতে শিখি, নিজের মতো করে ভালোবাসি। কেননা নিজের দেশকে গড়েপিটে নিতে হবে নিজেদেরই।
আয়কর মেলা চলবে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। মেলায় আসুন, কর দিন। রোভার স্কাউটরা আপনার পাশেই থাকবেন।
খাদিজা ফাল্গুনী

No comments

Powered by Blogger.