ধর্ম- বৈধ অর্থ-সম্পদ উপার্জনের নির্দেশনা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে যেমন সুন্দর দৈহিক গঠন, দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও আকৃতি দিয়েছেন, তেমনি উন্নত মন-মানসিকতা, বিবেক-বুদ্ধি ও পবিত্র আত্মা দান করেছেন।
মানুষের শরীরকে সুস্থ-সবল রাখার জন্য জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দরকার হয়। এসব আহার-সামগ্রী সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ অত্যাবশ্যক। এর জন্য মানবাত্মার সার্বিক কল্যাণে অবশ্যই হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পাপাচারমুক্ত রাখতে আয়-রোজগারে সর্বজনীন হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও উপযোগিতা অপরিসীম। ইসলামে হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কেননা, হালাল উপার্জন ব্যতীত ইমানদার হওয়া যায় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি তোমাদেরকে পবিত্র রিজিক হিসেবে যা দিয়েছি, তা থেকে তোমরা আহার করো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭২)
হালাল উপার্জন দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা ইসলামি জীবনব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে মানুষের ইহকালীন কল্যাণ, আত্মতৃপ্তি ও মানসিক শান্তি নিহিত; আর অবৈধ ও অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন রয়েছে মানুষের অকল্যাণ। অপরের ধনসম্পদ লুণ্ঠন বা আত্মসাৎ করে অসৎ উপায়ে টাকা কামানোতে কোনো শান্তি নেই। সৎ পথে বৈধভাবে উপার্জিত আয়-রোজগার মূলত জনকল্যাণমূলক অর্থ। একজন মুসলমান হিসেবে হালাল উপার্জনের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর ইবাদত-বন্দেগির জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইবাদত করা যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি হালাল উপার্জন বা রুজি অন্বেষণ করাও ফরজ। পবিত্র কোরআনে হালাল উপার্জনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘অনন্তর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তথা জীবিকা অন্বেষণ করো।’ (সূরা আল-জুমা, আয়াত-১০)
ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ কবুল হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল রুজি অন্বেষণ। যার রুজি হালাল নয়, তার যাবতীয় ইবাদত—নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। ধর্মপ্রাণ মানুষের আয়-উপার্জন হালাল না হলে বরকত হয় না এবং দোয়াও কবুল হয় না। ইমানের পর হালাল রুজি উপার্জন করে বৈধভাবে খাওয়া-পরা অন্যতম ফরজ কাজ। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘হালাল রুজি অন্বেষণ করা ফরজের পরেও আর একটি ফরজ।’(বায়হাকি)
হালাল উপার্জন করা মুমিন বান্দার মানবাধিকার। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা জুলুম। নিজ হাতে উপার্জন করে পৃথিবী থেকে নিজের প্রাপ্য অংশ ভোগ-ব্যবহার করা অবশ্য কর্তব্য। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে অন্যের অবৈধ আয়-উপার্জনের দিকে চেয়ে থাকা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। সৎভাবে জীবনযাপনে বৈধ পথে উপার্জন করতে হলে মানুষকে অনেক কঠোর পরিশ্রম করে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। অবৈধ উপায়ে উপার্জন তেমন কষ্টকর হয় না। কিন্তু হালাল উপার্জনের জন্য মানুষকে তিলে তিলে অনেক সময়, কায়িক শ্রম ও মেধা খরচ করতে হয়। এতে মানুষের মধ্যে কর্মবিমুখতা দূর হয়। অলসতা, কুড়েমি ও পরনির্ভরশীলতা তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমাদের ফজরের নামাজ আদায় হয়ে যাবে, তখন তোমরা জীবিকা অন্বেষণ না করে ঘুমিয়ে পড়বে না।’ (বায়হাকি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের উত্তরাধিকারীদের পরমুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল ও বিত্তবান রেখে যাওয়া উত্তম।’ (বুখারি)
দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিবারভিত্তিক জোরালো প্রতিবাদ হলে হারাম আয়-উপার্জনের যাবতীয় অসৎ পন্থা সমূলে উৎপাটিত হতে পারে। পরিবারের প্রধান যদি হারাম উপায়ে অন্যায়ভাবে আয়-রোজগার করেন, তা হলে তাঁকে প্রতিরোধ করার দায়িত্ব তাঁর অধীনদের ওপর পুরোপুরি না বর্তালেও এ অন্যায়-অপরাধের জের পুরো পরিবারকেই বহন করতে হয়। নিজেদের অর্জিত সম্পদ কীভাবে উপার্জন করা হয়েছে, এ নিয়ে যদি পারস্পরিক হিসাব-নিকাশ করা হয় তা হলে হারাম উপার্জন থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। এই মর্মে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল রুজি দ্বারা তার পরিবার-পরিজন প্রতিপালনের চেষ্টা করে, সে-ই উত্তম।’ হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘পরিবারের প্রধানের অসৎ পথে উপার্জিত অর্থের যে পাপ, তা তার অধীনস্থদের ওপর বর্তায় না। এ জন্য পরিবারের অধীনস্থদের আহ্লাদিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার রিজিক যেখান থেকে আসে তা তুমি যাচাই করে খাও। এটা কি হালাল না হারাম। যেহেতু আল্লাহ তোমাকে ভালো-মন্দের স্থান দিয়েছেন।’
একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে হালাল উপার্জন আমাদের ইমানি দাবি। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে হালাল উপার্জন অত্যাবশ্যকীয় কাজ। ইসলামে হালাল ও হারাম উপার্জন সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধান মোতাবেক জীবিকা নির্বাহ করতে হলে হালাল উপার্জনের কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) হালাল উপার্জন করার জন্য জনগণকে কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন জীবিকা অর্জনের চেষ্টায় নিরুৎসাহিত হয়ে বসে না থাকে।’ হালাল উপার্জনের তাগিদে সমাজে ধর্মপ্রাণ মানুষ চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন অন্যান্য কাজকর্ম ছাড়াও পশুপালন, হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, কৃষিকাজ, ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন ধরনের নার্সারি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি স্বাবলম্বনের বৈধ পন্থা গ্রহণ করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন।
হালাল উপার্জনের মাধ্যমে মানুষের মনে প্রশান্তি আসে এবং কলুষতা দূরীভূত হয়। হালাল পথে অর্থ উপার্জন করলে অন্তর সর্বদা প্রফুল্ল থাকে, আর হারাম উপার্জন মনে অস্থিরতা বাড়ায়। তাই সর্বদা আল্লাহর ভয় মনে জাগ্রত রেখে নিজেকে প্রতিনিয়ত সৎ পথের পথিক হিসেবে তৈরির জন্য চিরস্থায়ী নিবাসের কথা চিন্তা করে সব ধরনের অসৎ পন্থা অবলম্বন থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.