পোশাক কারখানায় আগুন- স্বজনের খোঁজে আসা মানুষ বিভ্রান্ত, নিয়ন্ত্রণকক্ষ নেই by গোলাম মর্তুজা ও অরূপ রায়

মেয়ে আসমা খাতুনের খোঁজে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে এসেছেন তফুরউদ্দীন। পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনসের পাঁচতলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আসমা। কিন্তু কার কাছে গেলে মিলবে মেয়ের খোঁজ, তা জানেন না তিনি। মেয়ের মৃত্যু হয়ে থাকলে কী প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা-ও জানা নেই তাঁর।
আগুন লাগার পর প্রতিদিনই নিশ্চিন্তপুর রেজিস্টার্ড বেসরকারি স্কুল মাঠে যান তফুরউদ্দীন। অনেক শ্রমিক সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমের কর্মী তাঁর কাছ থেকে মেয়ের তথ্য নিয়ে গেছেন। কিন্তু লাশ শনাক্তের বিষয়ে কেউ কিছু বলেননি। কী করতে হবে, তা-ও কেউ বলছেন না। অবশেষে গতকাল আশুলিয়া থানায় গিয়ে তিনি ‘৪০০ টাকা দিয়ে’ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডি নম্বর ছাড়া পুলিশের কাছে কোনো নির্দেশনাও পাননি তিনি।
তফুরউদ্দীনের মতো অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিশ্চিন্তপুর এলাকায়। তাঁরা বিভ্রান্ত, কোথায় যেতে হবে জানেন না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য জানানোর মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনেরা। নিখোঁজদের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। প্রশাসন বা বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নিখোঁজদের তালিকা করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও শ্রমিক সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে তালিকা করার কাজ শুরু করলেও তারা তা চূড়ান্ত করতে পারছে না। তারা নিশ্চিন্তপুর এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার দাবি করেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫৩ জনের পরিচয়হীন লাশ জুরাইনে দাফন করা হয়েছে। অথচ গতকাল পর্যন্ত আশুলিয়া থানায় নিখোঁজের বিষয়ে জিডি হয়েছে ৩১টি। আর লাশ শনাক্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে অবস্থিত ডিএনএ গবেষণাগারে এখন পর্যন্ত ১৫ জন স্বজন ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।
তফুরউদ্দীনের জিডি: তফুরউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল আশুলিয়া থানায় গিয়ে মেয়ে আসমা খাতুনের নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করতে চাইলে একজন জিডি লিখে দেওয়ার জন্য টাকা দাবি করেন। শেষে ৪০০ টাকায় রফা হয়। জিডিতে লেখা হয়, তাঁর মেয়ে আসমা খাতুন তাজরীনের পঞ্চম তলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তাঁর খোঁজ মিলছে না। লাশও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সরকারি নম্বরে ফোন করা হলে তা ধরেন উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, যাঁরা সরাসরি পুলিশের কাছে আসেন, তাঁদের কারও কাছে টাকাপয়সা নেওয়া হয় না। থানার ‘রাইটার’ দিয়ে লেখালে তারা টাকা নিতে পারে। তফুরউদ্দীনের বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘রাইটার’ নামের কিছু লোক থানায় মামলা-জিডি লিখে টাকা নেয়। এরা পুলিশের সদস্য না হলেও থানার ভেতরে অবাধ যাতায়াত।
সরকারি নির্দেশনা নেই: একাধিক শ্রমিকনেতা ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিচয়হীন লাশের ডিএনএ পরীক্ষার পর তা স্বজনদের সঙ্গে মেলানো হবে। ডিএনএ মিললেই কেবল ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা নেই বলে জানিয়েছেন সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর হোসেন সরদার। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি নির্দেশে শুধু বেতন-ভাতা যাঁরা পাবেন, তাঁদের তালিকা তৈরির কাজ করা হয়েছে। আর যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ৪৩ জনের স্বজনকে ছয় লাখ টাকা করে চেক দেওয়া হয়েছে। আরও যাঁদের লাশ শনাক্ত হয়েছে, তাঁদের চেক সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিডিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, নিশ্চিন্তপুর এলাকার শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ পর্যন্ত তাঁরা ৪১ জন নিখোঁজের তালিকা সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর কারখানার সামনে নিখোঁজ-আহতদের তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা উচিত ছিল।
বেসরকারি সংস্থা কর্মজীবী নারীর সহ-সমন্বয়কারী সুলতানুল আজম বলেন, এ পর্যন্ত তাঁরা ৪৫ জন নিখোঁজের তালিকা সংগ্রহ করেছেন। তবে তা চূড়ান্ত নয়।
নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সাপেক্ষে বেতন ও অন্যান্য পাওনা গত বুধবার পরিশোধ করেছে কারখানার মালিকপক্ষ। তবে ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.