সেনাবাহিনী একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি by মিজানুর রহমান খান

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীই দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তারা একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের স্থিতির জন্য সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখা অপরিহার্য।
জেনারেল এরশাদের শাসনামলের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্কিন শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এ মন্তব্য করে। সিআইএ অবশ্য এ কথাও উল্লেখ করে যে, ‘সামরিক বাহিনী যদিও কোনো সরকার ভাঙতে বা গড়তে পারে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঐকতান নেই। তাদের শৃঙ্খলা দুর্বল। তাদের মধ্যকার দলাদলি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অব্যাহতভাবে হুমকির উৎস হয়ে আছে।’
১৯৮২ সালের নভেম্বরে সিআইএ বাংলাদেশের সামগ্রিক ঘটনাবলির ওপর ৪৯ পৃষ্ঠার একটি হ্যান্ডবুক প্রকাশ করে। এতে ১৯৭১-১৯৮২ পর্বের বাংলাদেশের ঘটনাবলির একটি বিশ্লেষণ রয়েছে। এতে চারটি সামরিক অভ্যুত্থানের কারণ ও প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছে সিআইএ। সিআইএ বাংলাদেশের তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস থেকে উল্লেখ করেছে যে, মোগল আমলে সেরা যুদ্ধহাতির জোগানের স্থান ছিল পূর্ববঙ্গ। পাশাপাশি বলেছে, ‘এটা এমন এক অঞ্চল, যেখানকার পুরো সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার’ অতীতও রয়েছে।
কৌতুক: সিআইএ এ প্রসঙ্গে বাঙালি রাজনীতি নিয়ে একটি কৌতুকও করেছে। তারা বলেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি জনপ্রিয় কৌতুকের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যথার্থভাবে ফুটে ওঠে। কৌতুকটি হলো: ‘এক বাঙালি—একটি রাজনৈতিক দল, দুই বাঙালি—দুটি রাজনৈতিক দল, তিন বাঙালি—এখনো দুটি রাজনৈতিক দল, তবে প্রত্যেকের দুটি করে উপদল রয়েছে।’ ১৯৮৫ সালের এক প্রতিবেদনে সিআইএ বলেছে, ‘এরশাদকে সহযোগিতা করার প্রশ্নে বিএনপি বিভক্ত ছিল। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ দিলে উপদলীয় বিএনপি ও মিত্ররা এরশাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে।’ উল্লেখ্য, হ্যান্ডবুকটি ১৯৮২ সালে প্রস্তুত করা হলেও এটির সম্পাদিত ভাষ্য গত বছরের ১১ জানুয়ারি অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাজনৈতিক মতবিরোধ: এই প্রতিবেদনের ২৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অধিকতর স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে এরশাদ যখন রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার অনুমোদন দেন, এর পরও যাতে বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব মাথাচাড়া না দিতে পারে, এই ফন্দি মাথায় রেখে জেনারেলরা নিষেধাজ্ঞা তুলে রাজনৈতিক দলগুলোকে মাঠে নামতে দিয়েছিল।’
সিআইএ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের পরিবর্তে তীব্র মতবিরোধ এবং সর্বোপরি দলের ওপরে ব্যক্তিকে স্থান দেওয়ার প্রবণতার কারণে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধী মঞ্চ তৈরি করতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে।’
বিমুখ সেনা: একাধিক প্রতিবেদনে সিআইএ পূর্বাভাস দিয়েছিল যে রাজনীতিকেরা নন, জেনারেলরাই তার বড় হুমকি। ১৯৮৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘সামরিক বাহিনী সম্ভবত এরশাদকে সমর্থন করে যাবে। তার কারণ, এরশাদের চেয়ে উত্তম বিকল্প তাদের সামনে নেই। সেনাবাহিনী বামপন্থী এবং ভারতপন্থী বিরোধী দলকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে।’ তবে এই প্রতিবেদনেই এ কথা বলা হয়েছিল যে, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়লেই এরশাদের আসন টলবে। তখন কট্টরপন্থী জেনারেলরা হস্তক্ষেপ করবেন, বিরোধী দলকে দমন করবেন এবং হয়তো এরশাদকে অপসারণ করবেন।’
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এরশাদকে বিমুখ করছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান মোহাম্মদ নূরউদ্দীন খান ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদকে সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অথচ সিআইএ বলেছে, এরশাদের সেনাশাসনের তিনি ‘অন্যতম মস্তিষ্ক’। এরশাদের সঙ্গে জেনারেল আতিকুর রহমানের ঘনিষ্ঠতা এবং জেনারেল আবদুল মান্নাফের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির তথ্য রয়েছে সিআইএর প্রতিবেদনে।
একই বছরের ২১ জুন ‘বাংলাদেশ: এরশাদের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের গোড়াতেই বলা হয়েছে, কোন্দলে জর্জরিত দলগুলোর নাকের ডগায় এরশাদ উপজেলা নির্বাচন করে নিজের আসন অনেক পোক্ত করেছেন। এখন কেবল সামরিক বাহিনীই তাঁকে সরাতে পারে। অবশ্য এই প্রতিবেদন একই সঙ্গে এও বলেছে, ‘তাঁর সহযোগীরা তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ কিংবা বিরোধী দলের দাবি মেটাতে গেলেই তাঁরা খড়্গহস্ত হবেন।’ এতে আরও মন্তব্য করা হয় যে, ‘এরশাদ জাতীয় নেতা নন জেনেও জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা এরশাদকেই রাখতে পছন্দ করেন। কারণ, বেশির ভাগ জেনারেল এটা বোঝেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা বিরাট। এর দায়িত্বের বোঝা তাঁরা বইতে নারাজ। আর এরশাদের নেতৃত্ব প্রশ্নে সেনাবাহিনীর নিম্ন পর্যায়ে তেমন কোনো ভিন্নমত দেখা যায় না।’ ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারির অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এরশাদ সব সময় সেনাবাহিনীর চোখে নিজেকে যোগ্যতম বলে প্রমাণ দিতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি প্রমাণ করতে চাইতেন যে, সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে এবং বিরোধী দলের সঙ্গে কার্যকর দর-কষাকষিতেই তিনিই দক্ষ।’
দলাদলিতাড়িত: ১৯৮৩ সালের ১৭ জুন ‘দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশে বড় নিরাপত্তা সমস্যা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সিআইএ বলেছে, ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি। এ দেশ শাসনে তারা একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে যাবে।’ এই প্রতিবেদনেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘দলাদলিতাড়িত’ এবং ‘অভ্যুত্থান-উন্মুখ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ভারতের অভিসন্ধি বিষয়ে এরশাদ সরকার সম্ভবত অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ থেকে যাবে এবং চীনকে তারা সোভিয়েত ও ভারতের বিপরীতে ভারসাম্য হিসেবে দেখবে। আর নিজের বাঁচার জন্য তিনি পশ্চিমা সাহায্য ও বিনিয়োগের ভরসায় থাকবেন।’
অস্পষ্ট অংশে কী ছিল: প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনেই বাংলাদেশবিষয়ক অনেক কিছুই কালি দিয়ে লেপ্টে দেওয়া আছে। এই অংশটি অস্পষ্ট। ১৯৮৪ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমাদের মতে, এরশাদ সামরিক থেকে বেসামরিক ব্যবস্থায় ফিরতে গিয়ে বিরাট আন্দোলনের মুখে পড়বেন।’ এর পরই কয়েকটি বাক্য মুছে দেওয়া। এরপর লেখা, ‘তদুপরি আমরা মনে করি, আগামী ১২ মাস তাঁর টিকে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে। আমরা বিশ্বাস করি, মাঝেমধ্যে আন্দোলনের চাপ সত্ত্বেও এরশাদের সামরিক সহযোগীরা বিভক্ত বেসামরিক রাজনীতিকদের তাঁর সরকারকে টপকে যেতে দেবেন না এবং অস্থিরতা দমন করতে যা কিছু করা দরকার, তার সবটাই তাঁরা করবেন। এরশাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কোনো জেনারেল যদি ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁরা প্রত্যেকেই মোটামুটি এরশাদ-অনুসৃত বিদেশনীতিই অনুসরণ করবেন। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা তখনই সবচেয়ে বেকায়দায় পড়বেন, যদি বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। যদিও তেমন ঝুঁকি নেই, তবু ঢাকায় গোলযোগ হলে তা জেলা শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তাতে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে যাবে। তখন একাত্তর সালের মতো হাজার হাজার উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নেবে, যেটা ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’
বাম শোধন: ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইএর পূর্বাভাস প্রদান ও হুঁশিয়ারি-সংক্রান্ত এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা গ্রাহাম এ ফুলার এ বিষয়ে সিআইএর পরিচালকের কাছে পাঠানো এক স্মারকে উল্লেখ করেন, ‘সত্তরের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বাম শোধনে ব্রতী হয় এবং তারা অপেক্ষাকৃতভাবে সোভিয়েত প্রভাববলয়ের বাইরে বেরিয়ে আসে। অস্ত্র কেনায় তারা পূর্ব ব্লকে নয়, পশ্চিমের দিকে নজর দেয়।’
সামর্থ্য: সিআইএ বলেছে, ‘বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সাফল্যজনক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। কিন্তু আধা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তারা একটি ব্যাপকভিত্তিক গেরিলাযুদ্ধে শামিল হতে পারে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা তারা শহরাঞ্চলে দিতে পারলেও সারা দেশে পারার সামর্থ্য সীমিত। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা এবং কোনো সম্ভাব্য হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নিজেদের একটি আধুনিক, উচ্চ প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের সংকল্প রয়েছে।’
আগামীকাল পড়ুন: ‘ক্যারিশমেটিক’ জিয়া সেনা রাজনীতিকীকরণ করেছেন

No comments

Powered by Blogger.