জাপান-বিপদকে যারা করবে জয় by মোঃ মোতাহের হোসেন

প্রথমদিকে সবার মধ্যে যে আতঙ্ক কাজ করছিল সেটি আর এখন নেই। একটু একটু করে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া এবং তা থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অবশ্যই সময়ের ব্যাপাজা পানে ভূমিকম্প ও সুনামি অনেকটা রুটিনমাফিক ব্যাপার।
জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত অগি্নবলয়ের ওপর অবস্থিত হওয়ার কারণে সারাবছরই এ দেশে ভূমিকম্প লেগে আছে। বছরে প্রায় দেড় হাজারবার ভূমিকম্প হয় এ দেশে। বিশেষ করে ৩/১১-তে ভূমিকম্প ও সুনামি সংঘটিত অঞ্চলটি সাগরের নিচে আগ্নেয়গিরির খুব কাছে অবস্থিত হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে এখানে এ রকম ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। জানা যায়, ১৮৬৯ সালেও জাপানের ঠিক একই এলাকায় বড় এক ভূমিকম্প ও সুনামি হয়েছিল এবং তখন প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ঠিক এখানেই ১৮৯৬ সালে এ যাবৎ কালের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮.২ মিটার উঁচু সুনামি হয় এবং প্রায় ২২ হাজার লোক মারা যায়। ১৯৩৩ সালে মারা যায় ১৫২২ জন। এ ছাড়া ১৯২৩ সালে ৮.৩ মাত্রার গ্রেট কনতো (টোকিও, ইয়োকোহামা) ভূমিকম্পে ১ লাখ ৪৩ হাজার লোক মারা গিয়েছিল। ১৯৯৫ সালে কোবেতে মারা যায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার লোক। ভূমিকম্প ও সুনামিতে লোক মারা যাওয়া, জানমালের ক্ষতি হওয়ার ঘটনা এ দেশে প্রতিনিয়তই ঘটে। ২০০০ সালে জাপানের কেন্দ্রীয় সরকার সতর্ক করে বলেছিল, আগামী ২০ বছরের মধ্যে এ এলাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৮০ ভাগ। ২০০৪ সালে মিয়াগি প্রদেশের (দুর্গত এলাকা) এক রিপোর্টে বলা হয়, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ও ৮ থেকে ১০ মিটার উঁচু সুনামি নিকট ভবিষ্যতে এখানে আঘাত হানতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, জাপানের এ রকম একটা বিপজ্জনক জায়গায় জাপান কেন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বসাতে গেল? কেন জাপান সেই ৪১ বছর সময় থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এই পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করে দিল না? আর কেনইবা এ সময় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জির প্রধান একজন জাপানি নাগরিক? তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার ব্যাপার তো খোদ জাপানিদের মনেই সংশয় দেখা দিয়েছে।
এলাকার লোকজন পূর্ব সতর্কীকরণকে সব সময়ই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু তারা অন্য একটা মারাত্মক ভুল করে বসে। ভুলটা হচ্ছে এখানকার সমুদ্রের মোহনায় দেওয়া সুনামি রক্ষা বাঁধের ওপর তারা বেশি ভরসা করে ফেলেছিল। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। মনে করা হয় এটাই স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। জাপান থেকে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরের চিলির সেই ভূমিকম্প ও সুনামিতে গত ৩/১১-তে দুর্গত এলাকার ১৪২ জন লোক মারা যায়। এরপর জাপান সরকার এ এলাকায় (ইওয়াতে ও ফুকুশিমা প্রদেশ) সুনামি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক বাঁধ নির্মাণ করে। এর মধ্যে একটা বাঁধ ছিল আড়াই কিলোমিটার। ১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৩০ বিলিয়ন ইয়েন খরচ করে সেটা নির্মাণ করে। গ্রেট ওয়াল বলে খ্যাত এ বাঁধ সমুদ্রের নিচের ভূপৃষ্ঠের ৬৩ মিটার গভীর থেকে গেঁথে তোলা হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু এ বাঁধ পানির নিচে চওড়ায় ছিল ৮ মিটার, যা পৃথিবীর অন্যতম বিশাল সুনামি রক্ষা বাঁধ হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পায়। দু'মাস আগেও ভূমিকম্প ও সুনামি সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় স্থানীয় লোকজনের আলোচনার বিষয় ছিল এ রকম_ জাপানের অন্য কোনো স্থানে ভূমিকম্প বা বড় কোনো দুর্যোগ হলে তারা কীভাবে তাদের এখানে এনে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস ছিল, এত শক্ত ও উঁচু বাঁধ ভেঙে অথবা ওপর দিয়ে সুনামি কখনোই লোকালয়ে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু এবার তাদের বিশ্বাস ও গ্রেট ওয়াল দুটিই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে পরীক্ষা করে দেখেছেন, এবার জাপানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সুনামির উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ ৩৭.৯ মিটার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ২৫০টি জাম্বো প্লেন ১০০০ কিলোমিটার গতিতে এসে আঘাত হানার মতোই গতি ছিল গত ৩/১১ তারিখের সুনামিতে।
ওইদিন জাপানের ৪৭টি প্রদেশের মধ্যে ১২টিতেই সুনামি আঘাত হানে। ৯ মাত্রার ভূমিকম্প জাপানের কতটাইবা ক্ষতি করতে পারত, যা সুনামিতে হয়েছে। আধুনিক মিডিয়ার সুবাদে পৃথিবীর সব দেশ থেকেই হয়তো সে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে থাকবে।
জাপানের প্রতিটি জিনিসেরই একটা সূক্ষ্ম পরিসংখ্যান আছে। দেরিতে হলেও কী পরিমাণ মানুষ মারা গেছে সেটা স্পষ্টভাবে জানা যাবে। আজকের হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১৩২২৮, নিখোঁজ ১৪৫২৯ জন, আহত ৪৭৩৫ জন। তবে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের কেউ আর বেঁচে নেই। ফলে তাদের পরিবার থেকে কেউ মারা যাওয়া অথবা নিখোঁজ হওয়ার তথ্য আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ পৃথিবীর সব দেশের মানুষের এক রকম নয়। এদিকটা জাপানিদের ক্ষেত্রে একটু অন্য রকম, গবেষণার বিষয়। জাপান ইতিমধ্যে শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তেজস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা তো বটেই এখন তাদের বড় কাজ যেটা তা হচ্ছে ৪০ মিলিয়ন টন আবর্জনা সরিয়ে ফেলা এবং যথাসম্ভব কম সময়ের ব্যবধানে দুর্গত এলাকায় আধুনিক শহর ও বাসস্থান গড়ে তোলা। যেমনটি তারা হিরোশিমা, নাগাসাকিতে গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ১৯৪৫ সালে জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যায়। এর মাত্র ১৯ বছর পর ১৯৬৪ সালে টোকিওতে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর থেকেই বুলেট ট্রেন চলতে শুরু করে। ঠিক তেমনি ২০২২ সাল জাপান আবার অলিম্পক গেম আয়োজন করার ইচ্ছা পোষণ করছে। তারা বিশ্ববাসীকে বলতে চায়, সবাই দেখুক এরা কত তাড়াতাড়ি রিকভার করতে পারে, কত উন্নত এ দেশ। জাপানিদের এই শক্তি ও উন্নতির পেছনে অন্যতম দুটি দিক হচ্ছে জাপানিরা মনে করে, পৃথিবীর অন্য ৫টা দেশ বা জাতি থেকে তারা ভিন্ন। যদিও এখানে একটা বিতর্কিত বিষয় আছে বৈকি। অন্যটি হলো, কোনো প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন_ ভূমিকম্প, সুনামি, আগ্নেয়গিরি, টাইফুনে ভরপুর এ দেশটির মানুষ ভালো থাকার চেয়ে বরং নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যই নিরলস কাজ করে উন্নতি লাভ করেছে। এখন এ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ সবার মুখে একটাই স্লোগান 'গামবারে নিপ্পন' (জাপান শক্ত হও, শক্তি অর্জন কর, চেষ্টা কর)। জাপানিদের জাতিগত ডিএনএর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন_ ৩ বছরের এক বাচ্চা, টিভিতে দুর্গত এলাকার অন্য এক বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে সে কাঁদছে কেন? তার বাবা তাকে বলে, ওদের ঘরবাড়ি সব ভেঙে গেছে। থাকা-খাওয়ার সমস্যা, তাই সে কাঁদছে। তখন বাচ্চাটি তার বাবাকে বলে, আমার ছোট্ট ব্যাংকে সঞ্চয়ের টাকাগুলো তাকে পাঠিয়ে দাও। তাহলে সে কেক, আইসক্রিম এসব কিনে খেতে পারবে। এরপর বাচ্চাটি কাঁদতে থাকে এবং বারবার তার বাবাকে বলতে থাকে_ টাকা পাঠিয়ে দাও, এখনই টাকা পাঠিয়ে দাও। এ মহূর্তে বিরোধী দল থেকে সরকারের কোনো সমালোচনা তো নয়ই বরং বিরোধী দল থেকে বলছে, পার্লামেন্ট অধিবেশনের দরকার নেই, দেশের জন্য কাজ কর। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে জাপানে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার আছে। জাপানের বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার বা গভর্নর নিজ উদ্যোগে দুর্গত এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিয়ে তাদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষা, বাসস্থান সবরকম ব্যবস্থা করছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু আসে যায় না। বরং চাপ কমে গেছে অনেক। কর আদায় ও বাজেট প্রদানে স্থানীয় সরকার স্বাধীনভাবে কাজ করে।
প্রথমদিকে সবার মধ্যে যে আতঙ্ক কাজ করছিল সেটি আর এখন নেই। একটু একটু করে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া এবং তা থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অবশ্যই সময়ের ব্যাপার। এ ছাড়া সমস্যা আছে বিদ্যুৎ নিয়ে। গত ৩/১১-এর আগে শুধু টোকিও শহরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হতো তা ছিল পুরো ইংল্যান্ডে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান। বিদ্যুৎ চলে যায় না। তবে তারা খুব হিসাব করে খরচ করছে। যেমন_ ট্রেন ২ মিনিট পরপর আসার পরিবর্তে ৫ মিনিট পর আসার কারণে প্রচণ্ড ভিড় হয়। রাস্তাঘাট, দোকানপাট_ সব জায়গাতেই যৎসামান্য লাইট। সবকিছু ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে করার মতো বিদ্যুৎ ব্যবহারের বেলায়ও এ দেশের জনগণ নিজে থেকে যে ভূমিকা পালন করছে তার তুলনা শুধু জাপান এবং জাপানের বিশেষ জনগোষ্ঠী।
সরকারের পক্ষ থেকে বলছে, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করার ব্যাপারে তেজস্ক্রিয়ার দিকটাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা করা হবে। কথা হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ ফরমালিন খাই, রাতারাতি শাকসবজি বড় করার জন্য যেভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করি, তরিতরকারি ও ফলমূলে যেভাবে কীটনাশক দিই, সেখানে খাদ্যে কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয়া থাকলে আমাদের ক্ষতি করতে পারে সেটাই প্রশ্ন। ঘটনার পরপরই থাইল্যান্ড জাপানে চাল পাঠাতে চেয়েছিল। জাপান বলেছে, নো থ্যাংক ইউ, থাইল্যান্ডের চাল জাপানিরা খাবে না। বিদেশ থেকে পাঠানো কয়েক হাজার টন সাহায্যসামগ্রী জাপানের বিভিন্ন বন্দর ও এয়ারপোর্টে পড়ে আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অপেক্ষায়। কথায় আছে, রোগী আপন হলেও রোগ আপন নয়। তাই বলে রোগীর সামনে তার রোগ নিয়ে তিরস্কার করা যায় না। একটা দেশের এই দুঃসময়ে আমাদের সে কথাটা মনে রাখা দরকার। ৩/১১-এর ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৩ জন বিদেশি মারা গেছে। জানা মতে, আমরা জাপান প্রবাসী বাঙালি সবাই ভালো আছি ইনশাআল্লাহ। তবে রেমিটেন্স অনেক কমে যাবে।

মোঃ মোতাহের হোসেন : কলাম লেখক
hossainbj786@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.