আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী আতঙ্ক by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

আগামী নির্বাচনে অনেক আসনে দলের 'বিদ্রোহী' প্রার্থী থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। প্রায় প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে স্থানীয় নেতাদের। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন অনেক সময়ই সঠিক হয় না।
এ কারণে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে আওয়ামী লীগে। আর সম্প্রতি বেশির ভাগ নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে দলটি। এ কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে নানা কৌশল নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
গত বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে দলটির সংশয়ের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে সামনের নির্বাচনে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও এ কাজে ব্যবহার করতে চাইছে দলটি।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দলের কোনো কর্মী মনোনয়ন অগ্রাহ্য করলে দলের শৃঙ্খলাই শুধু নয়, গণতন্ত্রের ভীতও নড়ে যায়।
আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে সংশোধিত ও অনুমোদিত গঠনতন্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা অধ্যায়ে জাতীয় নির্বাচনে কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রার্থী হলে তাকে সরাসরি বহিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত সাপেক্ষে তাকে বহিষ্কারের কথা বলা হয়েছে দলীয় গঠনতন্ত্রে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে গঠনতন্ত্রের এই ধারা কঠোরভাবে মানা হবে বলে জানিয়েছেন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রার্থী হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।'
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে কিছুটা বিদ্রোহ থাকবেই। তবে জাতীয় নির্বাচন ছেলে খেলা নয়। ওই নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে দল সতর্ক থাকবে। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করলে তার ব্যাপারে কঠোর হবে দল।' সঠিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের জরিপ চলছে বলেও জানান মতিয়া চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান সাবেক সচিব রাশিদুল আলম বলেন, কেউ যেন দলীয় নিয়ম ভেঙে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, 'এবার বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে দলের অবস্থান হবে কঠোর। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাকে গঠনতন্ত্র অনুসারে সরাসরি বহিষ্কার করা হবে।'
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশে দলের সংসদ সদস্যদের অবস্থা খুব ভালো নয়। সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতায় এমন অবস্থা। এ অবস্থায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে আগামী নির্বাচনের ফল দলের জন্য সুখকর হবে না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই কয়েক মাস আগে স্বীকার করেছেন, দলীয় এমপিদের অনেকের অবস্থা খারাপ। গত ১১ জুন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এমপিদের মধ্যে ৬০ জনের অবস্থা বেশি খারাপ।
সূত্র জানায়, একটি গোয়েন্দা সংস্থা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে দেশব্যাপী তাদের জরিপেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়টি উল্লেখ করেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়েছে ওই জরিপ রিপোর্টে।
সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি স্থানীয় বা জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে ছিল ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীই জয়ী হয়েছেন। গত ১৮ নভেম্বর টাঙ্গাইল-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। একই ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত দেশব্যাপী পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমনে প্রথম ব্যর্থতার পরিচয় দেয় আওয়ামী লীগ। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েও বিদ্রোহীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে সরাতে ব্যর্থ হয় দলটি। পৌরসভা নির্বাচনে এর খেসারতও দিতে হয়েছে দলটিকে। গত তিন বছরে পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে মোট ২৩৭টি। এগুলোর মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী জিতেছেন ৯০টিতে আর বিএনপির প্রার্থী জিতেছেন ৯৫টিতে। তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব কয়টি মেয়র পদেই পরাজিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল।

No comments

Powered by Blogger.