পৌরসভা ঘোষণা- স্বপ্ন দেখছে বোয়ালখালীবাসী

চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলা সদরের একটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ ও অন্য দুই ইউনিয়নের আংশিক এলাকা নিয়ে বোয়ালখালী পৌরসভা গঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে পৌরসভা বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ।
সরেজমিন ঘুরে পৌরসভা নিয়ে এলাকার মানুষের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন মুহাম্মদ শামসুল হক
বোয়ালখালীকে পৌরসভা ঘোষণার পর এখানকার বাসিন্দারা এলাকার উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এলাকার রাস্তাঘাট, সড়কবাতি পয়োনিষ্কাশনসহ নানা ক্ষেত্রে অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সর্বস্তরের মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে বলে তাঁরা আশা করছেন। পাশাপাশি কেউ কেউ হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের ধারণা নামের দিক থেকে বোয়ালখালীর গুরুত্ব হয়তো বাড়বে কিন্তু সাধারণ মানুষ তেমন উপকৃত হবে না। বরং কিছু লোকের অর্থ আয়ের পথ খুলে যাবে। সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপবে করের বোঝা।
এলাকার বাসিন্দা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউল হক, পৌর এলাকাভুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন বোয়ালখালীকে পৌরসভা করার সিদ্ধান্তকে। তাঁদের মতে, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া উপজেলাসহ দেশের নতুন অনেক পৌরসভার তুলনায় যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ নানা দিক দিয়ে বোয়ালখালী পৌরসভা করার জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত। এখানে ছোট-বড় ১৬ থেকে ১৭টি শিল্পকারখানা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও নতুন শিল্প গড়ে উঠবে। এগুলো থেকে ভালো অঙ্কের কর পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ অন্য সংস্থা থেকে উপজেলার জন্য অর্থবরাদ্দসহ যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় পৌরসভা হওয়ায় দুই সংস্থার জন্য আলাদা বরাদ্দ পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে পাওয়া অর্থ দিয়ে পৌর এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। এতে একই সঙ্গে এলাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কনফিডেন্স সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মহাব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন, পশ্চিম গোমদণ্ডীর বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন ও কধুরখিলের মো. রফিক আশা করেন, প্রথম প্রথম মানুষের কিছুটা কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সার্বিকভাবে এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। এতে শিল্পকারখানার প্রসার এবং কর্মসংস্থান আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে সদর গোমদণ্ডী ইউনিয়নের (পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সুনীল চন্দ্র ঘোষ জানান, এলাকার অধিকাংশ মানুষ পৌরসভা চায়নি। কারণ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এলাকার উন্নয়নে যেটুকু বরাদ্দ কিংবা অন্যান্য সেবা পাওয়া যায় পৌরসভার মাধ্যমে তার চাইতে বেশি কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বরং জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়বে এবং টাকাওয়ালাদের আরও টাকা কামানোর সুযোগ তৈরি হবে। একই মত উপজেলা বিএনপির একাংশের আহ্বায়ক মো. শওকত আলম, কধুরখিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস এবং পশ্চিম গোমদণ্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালামের। তবে পৌরসভার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন বলে জানান তাঁরা। সদর এলাকার মো. ইসমাইল, পশ্চিম গোমদণ্ডীর জমাদার হাটের মো. ইব্রাহীম, মনির আহমদ, পৌর এলাকার ব্যবসায়ী সৈয়দ বদিউল আলম ও এরশাদুল হক মনে করেন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তৈরির আগে পৌরসভা হওয়ায় জনগণকে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত করের বোঝা বইতে হবে। পৌরসভার প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলশাদ বেগম। তিনি বলেন, ‘পৌরসভা হলে পৌরবাসীকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর দিতে হলেও সার্বিকভাবে বাসিন্দারা লাভবান হবে। শিল্পকারখানা, হাট-বাজার, সনদসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা খাত ছাড়াও সরকারিভাবে পাওয়া উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ যোগাযোগ, সড়কবাতি, নালা-নর্দমা, পয়োনিষ্কাশন ও শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খরচ হবে। এতে সার্বিকভাবে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।’

এক নজরে পৌরসভা
১৯৯৭-৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বোয়ালখালীকে পৌরসভা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি (তখনকার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী) মো. জিল্লুর রহমান ২০০১ সালের ১৩ মে বোয়ালখালীতে এক সমাবেশে পৌরসভা গঠনের ঘোষণা দেন।
চলতি বছর ৪ অক্টোবর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উপজেলা সদর ইউনিয়ন (পূর্ব গোমদণ্ডী) সম্পূর্ণ, পশ্চিম গোমদণ্ডী ইউনিয়নের ছয় ওয়ার্ড ও কধুরখিল ইউনিয়নের তিন ওয়ার্ড নিয়ে পৌরসভা গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৩ নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পৌর প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী পৌর এলাকার আয়তন প্রায় সাড়ে ১৫ বর্গকিলোমিটার, লোকসংখ্যা ৬৬ হাজার ২৪১ জন। এর মধ্যে সদর ইউনিয়নে ২৮ হাজার ৯৫৬ জন, পশ্চিম গোমদণ্ডীর ২৭ হাজার ২৮৫ জন এবং কধুরখিলে প্রায় ১০ হাজার জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব গড়ে প্রায় তিন হাজার ১৬০ জন। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা পূর্ব গোমদণ্ডীতে, বর্গকিলোমিটারে প্রায় চার হাজার। সবচেয়ে কম পশ্চিম গোমদণ্ডীতে, বর্গকিলোমিটারে প্রায় আড়াই হাজার। পৌর এলাকার ৬৭ ভাগ জমিই কৃষি উপযোগী। তবে অকৃষিজীবী ব্যক্তির সংখ্যা ৭৫ ভাগ। শিপইয়ার্ড, টেক্সটাইল, লবণ, কাগজ, ভোজ্যতেলসহ ছোট-বড় ১৫ থেকে ১৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রধান প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে—টিকে পেপার, এফএমসি (ফ্রেন্ডস মাল্টিমিডিয়া কোম্পানি) ডক ইয়ার্ড, রিজেন্ট টেক্সটাইলস, কনফিডেন্স সল্ট, হক্কানি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, এএনজেড টেক্সটাইলস, পানামা বনস্পতি ও চারটি স্বয়ংক্রিয় ইট তৈরির কারখানা। এ ছাড়া রয়েছে অন্তত সাতটি বড় বিপণিবিতানসহ প্রায় আড়াই হাজার দোকানপাট, একটি ডিগ্রি কলেজ, পাঁচটি উচ্চবিদ্যালয়, সাতটি হাটবাজার, পাঁচটি ব্যাংক। বার্ষিক রাজস্ব আয় প্রায় ২২ লাখ ২১ হাজার টাকা।

No comments

Powered by Blogger.