সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া- থাইল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছেই লাখ টাকার মুক্তিপণ by আব্দুল কুদ্দুস

বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে মিয়ানমার হয়ে ট্রলার বা জাহাজে করে থাইল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছালে মালয়েশিয়াগামী সব যাত্রীকে সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর সেখানকার দালালেরা মাথাপিছু এক লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে যাত্রীদের ছাড়িয়ে নেন।
দালালেরা নিজস্ব গুদামঘরে যাত্রীদের আটকে রেখে তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাঁরা মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করেন, তাঁদের মোটরসাইকেলে করে পৌঁছে দেওয়া হয় মালয়েশিয়া উপকূলে। আর যাঁরা মুক্তিপণ পরিশোধ করতে পারেন না, তাঁদের দালালদের সঙ্গে চার বছরের চুক্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
ট্রলারের মাঝি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের রশিদুল্লাহ বলেন, টেকনাফ থেকে ট্রলার বা জাহাজে করে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে প্রত্যেক যাত্রীর কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু দালালেরা এ হিসাব যাত্রীদের দেন না। তাঁরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়ে তাঁদের ট্রলার বা জাহাজে তুলে দেন। পরে থাইল্যান্ড সীমান্তে গিয়ে অবশিষ্ট টাকা দাবি করেন। সেই টাকা পরিশোধ করা তখন অধিকাংশ যাত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে তাঁদের চার বছর পর্যন্ত দালালদের নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতে হয়। চার বছরে যা উপার্জন হয়, এর সবটাই দালালচক্র হাতিয়ে নেয়। শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে তারা। এভাবে আট বছর ধরে চলছে আদম ব্যবসা।
আরও কয়েকজন ট্রলারের মাঝি বলেন, একটি ট্রলার কক্সবাজার থেকে থাইল্যান্ড পৌঁছে দিলে প্রত্যেক মাঝিকে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা দিতে হয়। শীত মৌসুমের পাঁচ মাস (নভেম্বর থেকে মার্চ) সাগর একেবারে শান্ত থাকে। এই সুযোগে দালালেরা ট্রলারে করে লোক পাঠান মালয়েশিয়ার উদ্দেশে থাইল্যান্ডে। ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড পৌঁছাতে সাত দিন লাগে। আর জাহাজে লাগে তিন দিন। ট্রলারের মাঝিদের পরে মালয়েশিয়া থেকে বিমানে করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
কয়েকজন দালাল বলেন, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় আদম পাচারের পথটি বের করেন টেকনাফের জেলে তাজর মুল্লুক। এখন এই সমুদ্রপথ ২৪ জন মাঝির নিয়ন্ত্রণে। আর মাঝিদের নিয়ন্ত্রণে আছে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালীসহ বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২০০ দালাল। তাঁরাই মূলত নানা প্রলোভন দেখিয়ে যাত্রী জোগাড় করেন।
থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৪ জন মাঝির মধ্যে নিয়মিত মালয়েশিয়া যাচ্ছেন শাহপরীর দ্বীপের রশিদুল্লাহ, তাজ উদ্দিন, মহিবুল্লাহ, ফয়েজুল্লাহ, মো. হাশেম ওরফে পোয়া মাঝি, জাফর আলম, আবদুল্লাহ, তাজর মুলুক; সাবরাং এলাকার শাকের আহমদ; টেকনাফ সদরের নবী হোসন, আয়ুব আলী, সৈয়দ হোসন; মুচনী ক্যাম্পের মো. হোসেন; কক্সবাজার নুনিয়াছটার শাহ আলম, সৈয়দ আলম; চট্টগ্রাম ছিকলবাহার নুরুল ইসলাম, কামাল আহমদ এবং কর্ণফুলী এলাকার মোনাফ ও হামিদ মাঝি।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহামঞ্চদ ফরহাদ বলেন, তাঁদের মধ্যে পোয়া মাঝি, শাকের আহমদসহ বেশ কয়েকজন মাঝিকে গত নভেম্বরের শেষের দিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদেরও ধরার চেষ্টা চলছে। মাঝিদের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা। বন-জঙ্গলের বস্তিতে থাকেন বলে ধরা যাচ্ছে না।
পোয়া মাঝি বলেন, থাইল্যান্ডে পৌঁছার পর সেখানকার এক নারী দালাল যাত্রীদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। তারপর টাকা দিয়ে ফের যাত্রীদের মুক্ত করেন ওই নারী দালাল। এর পরই মুক্তিপণের লাখ টাকা আদায় করেন। টেকনাফ থেকে যাত্রীবোঝাই ট্রলার থাইল্যান্ড পর্যন্ত যেতে পথে পথে দালালেরা তৎপর থাকেন। মুঠোফোনে তাঁরা মাঝির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন। মাঝিদের আগে থেকে বিভিন্ন দেশের সিমকার্ড সরবরাহ করা হয়।
টেকনাফের সৈয়দ আলম মাঝি বলেন, যাত্রীদের বেশির ভাগ এখন বিদেশি জাহাজে করে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। পুরুষের পাশাপাশি এখন মেয়েরাও যাচ্ছেন, বিশেষ করে দালালেরা রোহিঙ্গা তরুণীদের মালয়েশিয়ার কথা বলে থাইল্যান্ডে পাচার করছেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ নভেম্বর ভোরে টেকনাফের খুরেরমুখ উপকূল দিয়ে ট্রলারে ওঠার সময় বিজিবি সদস্যরা সেতারা বেগম (৩০) নামের এক নারীসহ মালয়েশিয়াগামী ১৪ জন যাত্রীকে আটক করেন। সেতারা উপজেলার নীলা ইউনিয়নের মোছনী গ্রামের কামাল হোসেনের স্ত্রী।
মালয়েশিয়া পাচারের ঘটনায় গত তিন বছরে টেকনাফ থানায় বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের পক্ষ থেকে ১৭৯ জন দালালের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে; উদ্ধার করা হয়েছে তিন শতাধিক যাত্রীকে। এর পরও তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.