বন্ধু কী খবর বল... by তাসনীম হাসান

তারিখটা বেশ ছন্দময়—১.১২.১২। আবহাওয়াটাও অসাধারণ। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে যেন হাসছে প্রকৃতি। সবকিছুতেই উৎসবের আমেজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দিনটি অন্য দশটি দিনের মতো নয়। বিশেষ একটি দিন। পঞ্চাশের ঘরে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স। এবার গেল ৪৬।
এই আনন্দের রেশ ধরেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে জারুলতলার অভিমুখে শোভাযাত্রা, কেক কাটা থেকে শুরু করে রং-বেরঙের বেলুন ওড়ানো, মোমবাতি প্রজ্বালন—জন্মদিন পালনের কোনো কিছুই বাকি ছিল না উৎসবে।
অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, উপাচার্য মো. আনোয়ারুল আজিম আরিফ, অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন, প্রাক্তন উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ ফজলী হোসেন, এ জে এম নূরুদ্দীন চৌধুরী, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক। বক্তৃতাপর্বে অতিথি ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা স্মৃতিচারণ করেন।
অনুষ্ঠানমালার ফাঁকে ক্যাম্পাসের আনাচে- কানাচে প্রাক্তনেরা যেন খুঁজে ফিরছিলেন তাঁদের স্বর্ণময় দিনগুলো। পুরোনো সেই দিনের কথা স্মরণ করে অনেকেই হয়ে পড়েছিলেন স্মৃতিকাতর। বন্ধুদের কাছে পেয়েই মনের কোণে যেন বেজে উঠছে ‘হঠাৎ অফিস অঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে—বন্ধু কী খবর বল। কত দিন দেখা হয় না দুজনে।’ পেশাজীবনে ঢুকেছেন বলেই কি বন্ধুকে কাছে পাওয়ার আনন্দ বাধ মানে? বয়স-পেশা-বর্তমান ভুলে, ব্যস্ততা আর কাজের কথা ফেলে এক মুহূর্তের জন্য সবাই ফিরে গেলেন হারানো অতীতে। মেতে উঠেছিলেন গল্প-আড্ডা-গানে। আবার স্মৃতিময় মুহূর্ত ফ্রেমে বন্দী করতে ভুলছেন না কেউ। কিছুক্ষণ পর পর ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি এক যুগ আগে। কিন্তু এখনো মায়া ছাড়তে পারিনি। এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোনো বন্ধু ও নতুনদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।’
নতুনেরা পুরো ক্যাম্পাসে পাখির মতো কিচিরমিচির করছিলেন। শহীদ মিনার এলাকায় দলবেঁধে ছবি তুলছিলেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া খান, তানিয়া নাসরিন ও বেলাল উদ্দিন। কেমন লাগছে, জিজ্ঞেস করতেই বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া খান উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভর্তি হওয়ার পর পরই এত বড় উৎসব, পুরোনোদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালোই লাগছে। এমন দিনের তুলনা হয় না।’
আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ। সৃষ্টিশীল আনন্দ ও নতুন জীবনের সন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা রাখে।’ ৪৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, ‘শিক্ষা-গবেষণাসহ ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন কম নয়। আরও বেশি অর্জন আমাদের কাম্য ও লক্ষ্য।’ কথামালা আর আড্ডার ফাঁকে গড়িয়ে যায় সময়। পাহাড়ের কোলে নামে সন্ধ্যা। তখন মঞ্চে সুরের মায়া। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উল্লাস যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রাত নয়টার দিকে মঞ্চ মাতাতে আসে ব্যান্ডদল ‘শিরোনামহীন’। ব্যান্ডের ভোকাল সুমন শুরু করেন ‘বন্ধ জানালা’ গানটি দিয়ে। একে একে গেয়ে শোনান ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’, ‘ভেবে দেখেছ কি’, ‘একা পাখি’, ‘ট্রেন’, ‘বাংলাদেশ’সহ ১০টি গান। অবশেষে ভাঙে মিলনমেলা। সবাই পথ ধরে আবার আপন গন্তব্যের। হূদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেয় স্মৃতিময় একটি দিন।
তবে এত বড় আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অতিথি আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছুটা কার্পণ্য করেছেন বলে অনুষ্ঠানের দিন উপস্থিত অনেকেই অভিযোগ করেছেন। প্রায় অর্ধশত বছরের এই প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে অন্তত কয়েকজনও যদি উপস্থিত থাকতেন এই আনন্দের মাত্রা আর অনুষ্ঠানের মানটা বাড়ত। অনুষ্ঠানটি তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে, পরিকল্পনার ছাপও তেমন ছিল না বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।

No comments

Powered by Blogger.