ছাত্রশিবির এবং ছাত্রলীগ প্রসঙ্গ by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

মাসের শুরুতে ইসলামী ছাত্রশিবির কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব ও পুলিশের ওপর নির্মম নির্যাতন আমাদের হতবাক করেছে। যদিও তাদের আক্রমণ আকস্মিক; কিন্তু পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী ও শক্ত। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির মরিয়া হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের বাঁচানোর জন্য তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চোরাগোপ্তা হামলা থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। তাদের একটি উদ্দেশ্য একাত্তরের ঘৃণ্য অপরাধের বিচার বন্ধ করা। তাদের ইচ্ছার পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে সমর্থন জানিয়ে আসছে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী দল দাবিকারী বিএনপি। প্রকাশ্যে বলছে না, আমরা বিচার চাই না; কিন্তু এ কথা বলছে যে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। এর মধ্যে এক ধরনের দ্বৈতনীতির গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। যারা প্রকাশ্যে পত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে নিজেরাই প্রমাণ করেছে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিরোধিতাই করেনি বরং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে তখন তাদের কি প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী বলা যায় না। প্রকাশ্য স্বীকারকারী যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের বিচার চলছে। বিএনপির কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই- আপনাদের কাছে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীর সংজ্ঞা কী? ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা না বলে প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিন। আপনাদের মুখোশ পুরোটা খুলে যাবে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, বিরোধী দলগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিরোধী দলসহ অনেক সাধারণ মানুষ এটিকে উড়িয়ে দেয়। মন্তব্য করে সরকার সব কিছুর মধ্যে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়সহ অতীতের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কি প্রমাণ করে না যে বিরোধী দলগুলো যেকোনোভাবেই হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ঠেকাতে চায়। বিচার ঠেকানোর জন্য তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় সরকার ও পুলিশ বাহিনী সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে বটে; কিন্তু তাদের সহনশীলতাকে দুর্বল মনে করে বিরোধীরা আরো কঠিন মূর্তি ধারণ করতে পারে। এদের এখনই শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে বাঁচানো যাবে কি না সন্দিহান।
আমাদের বেশ করণীয় রয়েছে; কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে এতটাই বেশি ব্যস্ত যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও এদের শক্ত হাতে মোকাবিলা করার শক্তি ও সাহস পাচ্ছি না। সম্প্রতি ছাত্রশিবিরের হামলার প্রতিবাদে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনসহ প্রগতিশীল স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি কি ভূমিকা পালন করেছে? ঢাকা শহরে একটি বা দুটি সমাবেশ ছাড়া তেমন কোনো কর্মকাণ্ড আমাদের চোখে পড়েনি। প্রগতিশীল পেশাজীবী গোষ্ঠী প্রতিবাদ-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রীকে এনে সমাবেশ করা ও গরম গরম কথা বলা বেশ কঠিন নয়; কিন্তু রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা, মানববন্ধন করা, সাধারণ মানুষকে জানিয়ে দেওয়া এ দেশ স্বাধীনতাকামীদের, স্বাধীনতাবিরোধীদের নয়- এমনটি একটু কঠিনই মনে হয়। আমাদের কাছে মনে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পরিবর্তে নিজেদের নেতা-নেত্রী হিসেবে জাহির করার ইচ্ছা প্রকট। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে পোস্টার ও ডিজিটাল ব্যানারের ছড়াছড়ি। জাতীয় দিবস, বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ ও নিজেকে সহযোগী সংগঠনের কোনো পদে মনোনীত করার জন্য নেতা-নেত্রীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের শেষ নেই। নিজেদের পরিচিত করতে আকর্ষণীয় রঙিন এ ধরনের পোস্টার ও ব্যানারে আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করছি। ব্যবহার করছি আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন ও নেতা-নেত্রীর নাম; কিন্তু এটা কি মনে করি না যে আওয়ামী লীগ সরকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আর এ জন্য আমাদের কিছু করা উচিত। যদি তা-ই মনে করি, তাহলে কোথায় প্রতিবাদ, কোথায় প্রতিরোধ? ইসলামী ছাত্রশিবির যেমন পুলিশকে মেরে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা এখনো সবল, তেমনি আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, আমরা আছি এবং থাকব। আমাদের নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়। একাত্তরে তোমরা গুটিকয়েক ছিলে এখনো তা-ই। তোমাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমরা জেগে আছি এবং জেগে থাকব। আর পোস্টার ও ডিজিটাল ব্যানারের নেতাদের বলতে চাই- নিজেদের পরিচিত করেন ভালো কথা; কিন্তু আওয়ামী লীগ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিরুদ্ধ যে ষড়যন্ত্রে চলছে, এর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হোন, নাহলে পালানোরও পথ পাবেন না।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এখন এক আতঙ্ক। অনেকের নিদারুণ ভয়ের কারণ। তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের হতাশ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ছিল গৌরবের ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অবদান অতুলনীয়; কিন্তু বর্তমান সময়ে তাদের বিপথগামিতা আমাদের মধ্যে কোনো আশার সঞ্চার করে না। এমন অবস্থা শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ তৈরিতে এক ধরনের প্রভাব পড়বে। বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে তারা এমন সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, যা জাতির জন্য অবমাননাকরই নয়, রীতিমতো ঘৃণার। ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠন অর্থ এই নয় যে টেন্ডারবাজি করা, এর অর্থ এই নয় যে ঘুষ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চাকরি দেওয়া। যদি তা-ই হয়, তাহলে নিজের গায়ে একটি দলের লেবাস লাগানোর পরিবর্তে সমাজে প্রতিহিংসাপরায়ণ গোষ্ঠী বা সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলানোই উত্তম। রাজনীতি যদি হয় মানুষের কল্যাণের জন্য তাহলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এ পথ পরিহার করা উচিত। অতি সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষকদের ওপর অতর্কিতে হামলায় আমরা হতভম্ব। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। ধিক্কার জানাই এবং শাস্তি দাবি করি ছাত্রলীগ নামধারী ওই সব ছাত্রকে।
অহিংস আন্দোলন করার অধিকার সবার রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের আন্দোলনও অহিংস ছিল। আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারাও। নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কোনো অন্যায় নয়। যেখানে বিরোধ শিক্ষক বনাম প্রশাসনের, সেখানে ছাত্রলীগের জড়ানো উচিত হয়নি। তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের সম্মানকে ম্লান করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। এক ধরনের জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। আবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও সব সহকারী প্রক্টররাও পদত্যাগ করেছেন। সরকার যখন বিভিন্ন ইস্যুতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে, তখন হঠাৎ করে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের এমন আচরণ সরকারের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট করবে বলে আমাদের ধারণা। এখন আমাদের একদিকে যেমন প্রয়োজন যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে অবস্থানকারী জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যদের কঠোরভাবে দমনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া, তেমনি সরকারের সহযোগী ছাত্রসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা। নইলে ক্রমে সরকারের প্রতি প্রগতিশীল পেশাজীবী গোষ্ঠীসহ সবার সমর্থন কমবে বৈ বাড়বে না।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.