নির্দলীয় সরকার না হলে লাগাতার হরতাল

জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার হরতাল দেওয়া হবে। কারফিউ কিংবা ইমার্জেন্সি দিয়েও কোনো কাজ হবে না। কারণ জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হলে তার পরিণতি শুভ হবে না। আরো কঠিন কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হব। এ কারণেও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে।' তিনি ১৮ দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও দেশের সর্বস্তরের মানুষকে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল বুধবার বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১৮ দলীয় জোটের বিশাল সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। সমাবেশ থেকে ঘোষিত কর্মসূচি হলো- আগামী ৯ ডিসেম্বর সব মহানগর-জেলা-উপজেলা-থানায় রাজপথ অবরোধ; ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে গণসংযোগ, এই কর্মসূচিতে খালেদা জিয়া নিজেই নেতৃত্ব দেবেন; আওয়ামী লীগের 'দুঃশাসনের' বিরুদ্ধে ২৩ ডিসেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ ও গণমিছিল; এ ছাড়া ১২ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দলীয়ভাবে বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোট বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন করবে; পাশাপাশি ৬ ডিসেম্বর গণতন্ত্র মুক্তি দিবসও পালিত হবে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আয়োজিত গতকালের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। সভা পরিচালনা করেন রুহুল কবির রিজভী, জয়নুল আবদিন ফারুক ও আবদুস সালাম। সমাবেশে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড এবং চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ভেঙে প্রাণহানির ঘটনায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, 'আওয়ামী লীগ ১৭৫ দিন হরতাল দিয়েছিল। আমরা সেই তুলনায় অনেক অনেক কম, মাত্র ১৩ দিন হরতাল দিয়েছি। সরকারকে বলে দিতে চাই, আমাদের কর্মসূচিতে বাধা দিলে এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে আপনাদের মতো লাগাতার কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব। আমরা বলে দিতে চাই, সরকার যত কিছুই করুক না কেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।' অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে তিনি বলেন, 'আমরা আপনাদের মতো নোংরা ভাষায় কথা বলতে চাই না। সংসদে সত্যটাই তুলে ধরতে চাই।'
খালেদা জিয়া বলেন, 'তারা (সরকার) যদি মনে করে ভালো কাজ করেছে, তাহলে জনগণ তাদের সুযোগ দেবে; আমরা আপত্তি করব না। কিন্তু সে নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নয়।' তিনি বলেন, বিএনপি কাজ করে আর আওয়ামী লীগ এসে সেই নামফলক ফেলে দিয়ে নিজেদের নামফলক বসায়। কিন্তু কাজ করতে পারে না। ক্ষমতায় গেলে এসব মিথ্যা নামফলক রাখা হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরকারের পদলেহী মিথ্যাবাদী সংস্থা আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, এর নাম 'মিথ্যাবাদী কমিশন' রাখা উচিত।
খালেদা জিয়া বলেন, এই সরকার জনগণকে দেওয়া ওয়াদা বাস্তবায়ন করতে পারে না। তাদের ক্ষমতায় থাকায় অধিকার নেই। তারা চার বছর কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু দেশের কোনো উন্নতি হয়নি। আর এক বছর মাত্র সময় আছে। শেষ সময়ে তারা কিছু টাকা ছড়াবে। কিন্তু সে টাকাও কাজে লাগবে না। খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকারের আমলে আবাসন শিল্পে কোনো ধরনের উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। কারণ ডেভেলপাররা বাড়ি বানিয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া ফেলে রেখেছেন। বিক্রি করতে বা ভাড়া দিতে পারছেন না।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। উদ্যোক্তারা মেশিন এনে বসে আছেন। গ্যাস ছাড়া কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। তাদের লোক এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ এ কথা বলেছেন। দেশে ৩৮টি ব্যাংক আছে, কিন্তু বিনিয়োগের টাকা নেই। হলমার্কের ঘটনার পর ব্যাংকগুলো টাকা দিতে চায় না।
বিএনপিপ্রধান বলেন, ড. ইউনূসকে দায়ী করে লাভ নেই। অর্থমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের আচরণের জন্যই বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। ড. ইউনূস দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে সরকার দলীয়করণ করতে চাইছে। তারা বিচার বিভাগকেও দলীয় করতে চাইছে।
খালেদা জিয়া বলেন, 'বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তারা ২১ জন ফাঁসির আসামিকে মাফ করে দিয়েছে। নিজেরা মানুষ হত্যা করছে, গুম করছে। কে এসব করছে তা আমরা জানি। যারা এসব করেছে তারা আমার সামনে শুধু নয়, টিভির সামনে এ অপকর্মের কথা স্বীকার করবে। সময় হলে প্রমাণসহ তা উপস্থাপন করা হবে।'
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের জনশক্তির একটি ভালো বাজার ছিল। সেই বাজার সরকার শেষ করে দিয়েছে।' বিএনপি ক্ষমতায় গেলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলে দেশের জনশক্তি রপ্তানি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিচ্ছেন বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করার। ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষকরা অপমানিত হচ্ছেন। এই ছাত্রলীগ-যুবলীগ ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদেরই ধ্বংস করবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ, কোনো রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে যথাসময়ে নির্বাচন দিন। তিনি বলেন, শুধু ১৮ দলীয় জোট নয়, আসুন, স্বাধীনতার মাসে সব রাজনৈতিক দল মিলে দেশটাকে রক্ষা করি।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্রি. জে. (অব.) হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান অলি আহমদ, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু প্রমুখ।
খালেদা জিয়া বিকেল সোয়া ৩টায় মঞ্চে ওঠেন। সোয়া ৪টায় শুরু করে প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন। নয়াপল্টনে সমাবেশ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। পূর্বে ফকিরাপুল মোড় ও পশ্চিমে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত পুরো সড়কে বিএনপি, শ্রমিক দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, জাসাস, ড্যাব, অ্যাগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা পুরো এলাকায় অবস্থান নেয়। এর আগে দুপুর থেকে মিছিল নিয়ে তারা সমাবেশে আসতে থাকে। পুলিশের বেঁধে দেওয়া সীমানা ফকিরাপুল ক্রসিং থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত সড়কের লাইটপোস্টগুলোতে আড়াই শ মাইক লাগানো হয়। দুই মোড়ে কয়েকটি বড় পর্দার টিভি স্থাপন করা হয়। সমাবেশ উপলক্ষে মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩০০ নেতা-কর্মী নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক টিম মঞ্চের চারপাশে এবং পাশের ভবনগুলোতে অবস্থান নেয়। দলীয় নিরাপত্তার বাইরে মঞ্চের চারপাশে দুই স্তরের পুলিশ বেষ্টনীর পাশাপাশি পুরো নয়াপল্টন সড়কের বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন ছিল। ভবনের ছাদে বসানো হয় পুলিশি পাহারা। মঞ্চের চারপাশে আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। আগের মতো খালেদা জিয়ার এ সভাও দেখানো হয় ইন্টারনেটে- www.bnplive.com।

No comments

Powered by Blogger.