পোশাক শ্রমিকদের দাবি বরাবরই উপেক্ষিত-বাধ্য হয়েই নামতে হয় সংঘাতে by রাজীব আহমেদ

পোশাক কারখানার ভাড়ার ওপর ৯ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পুরোপুরি উঠে গেছে। নতুন বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে মিলেছে নগদ ২ শতাংশ প্রণোদনা। প্রস্তাবিত উৎসে কর ১.২০ থেকে ০.৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি মেনেই চলতি অর্থবছরের (২০১২-১৩) বাজেটে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের আবাসন ও রেশনের ব্যবস্থা এবং ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবি এখনো হিমাগারে। সংঘাত ছাড়া তাদের দাবি কখনো পূরণ হয় না।
বিজিএমইএর দাবি-দাওয়ার শীর্ষে থাকে উৎসে কর কমানোর দাবি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক-বাজেট আলোচনায় পোশাক কারখানার মালিকরা তাঁদের কারখানায় ব্যবহার করা ইন্টারনেটের মূল্য সংযোজন কর উঠিয়ে নেওয়ার দাবিও করে থাকে। মালিকদের দাবিনামার মধ্যে শ্রমিক কল্যাণের জন্য দু-একটি দাবি থাকে না তা নয়। কিন্তু সেগুলোর দায়ও চাপে সরকারের ঘাড়ে। মালিকরা সরকারের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় করে ফেলেন। কিন্তু শ্রমিকরা সরকারের কাছে তেমন পাত্তা পায় না। ফলে আবাসন, রেশন, পরিবহন সুবিধা ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শেষ পর্যন্ত সংঘাতেই যেতে হয় শ্রমিকদের। সংঘাত ঠেকাতেও মালিকদের আছে নানা কৌশল। অভিযোগ রয়েছে, অনেক শ্রমিক সংগঠন মালিকদের পকেট সংগঠন হিসেবে কাজ করে। কারখানা পর্যায়ে যেসব শ্রমিক একটু আন্দোলনমুখী হয়, তাদের শায়েস্তা করতে কাজে লাগানো হয় ঝুট ব্যবসায়ীদের। মালিকদের কাছ থেকে বিনা মূল্যে ঝুট নিয়ে তারা কাজ করে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, সংঘাত ছাড়া শ্রমিকদের কোনো দাবি কখনো পূরণ হয় না। ২০০৬ সালের নতুন মজুরি কাঠামো, ২০১০ সালের নতুন মজুরি কাঠামো- সবই এসেছে সংঘাতের পর। মালিকরা নিজেদের ইচ্ছায় কখনো কিছু করেননি।
পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়েছিল ২০০৬ সালের অক্টোবরে। এর আগে পোশাক শিল্প খাতে ভয়াবহ সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বহু কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয় পোশাক শ্রমিকরা। এরপর তাদের মজুরি বাড়ানো হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে নতুন কাঠামো অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি পেতে শুরু করে পোশাক শ্রমিকরা। তবে এটা পেতেও তাদের সংঘাতে নামতে হয়। চলে জ্বালাও-পোড়াও।
পোশাক শ্রমিকদের রেশন চালু করার দাবিটি পূরণ হয়নি। কয়েক বছর আগে একবার কিছু পোশাক শিল্পঘন এলাকায় রেশন চালু করা হয়েছিল। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। আর রেশন দেওয়ার দায়টি সরকারের কাঁধে চাপিয়েছেন পোশাক মালিকরা। তাঁরা চান সরকার শ্রমিকদের রেশন দিক। তাঁরা নিজেরা দেবেন না।
গত ২৫ জুলাই তখনকার শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, সরকার পোশাক শ্রমিকদের জন্য রেশন চালুর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু জানা গেছে, পোশাক মালিকদের সঙ্গে দাম নিয়ে জটিলতায় রেশনের বিষয়টি ঝুলে আছে। সরকার চাইছে প্রতি কেজি চাল সাড়ে ২২ টাকা দরে বিক্রি করতে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ চাইছে ২০ টাকা কেজিতে কিনতে। এ জটিলতায় রেশন শেষ পর্যন্ত পায়নি শ্রমিকরা। আর বিজিএমইএ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চাল, আটা, তেল, চিনি ও দুধ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চাল, আটা ছাড়া কিছু নেই।
আবাসনের জন্য অর্থায়নের দায়ও সরকারের কাঁধে চাপিয়েছেন মালিকরা। শ্রমিকদের ডরমিটরি নির্মাণের জন্য তাঁরা ১ শতাংশ সুদে ঋণ দাবি করেন। অবশেষে সরকার গত বছর সেই দাবি পূরণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই টাকা নিয়ে একটি ডরমিটরিও হয়নি। এর কারণ সরকারের একটি শর্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, কোনো অলাভজনক সমিতি শুধু এ ঋণ নিতে পারবে। ফলে মালিকরা এ ঋণ পাচ্ছেন না।
গত ঈদুল ফিতরের আগে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে এক সংবাদ সম্মেলনে বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান বলেছিলেন, এ জন্য তাঁরা ঈদুল আজহা পর্যন্ত সময় চান। এরপর সব পক্ষের সঙ্গে বসে দেখবেন কী করা যায়। কিন্তু ঈদুল আজহা অনেক আগেই শেষ হলেও মজুরি বাড়ানোর দাবিটি এখন আর আলোচনায় আসছে না।
বিকেএমইএর সভাপতির সময় চাওয়া প্রসঙ্গে সংগঠনের সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, 'কোরবানির ঈদের পরে একবার আমরা শ্রমিকদের নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু পরে তা আর এগোয়নি।'
আবাসনের জন্য ১ শতাংশ সুদে ঋণ পেতে বাধা সম্পর্কে বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম বলেন, 'তাদের আইন নিয়ে তারা থাক। এ দেশে প্রধানমন্ত্রী বলে দেওয়ার পরও একটা বিষয়ের সমাধান হয় না।'
বিকেএমইএর সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, '১ শতাংশ সুদে ঋণ কারখানার মালিকদের দেওয়ার জন্য আমরা বহুবার বলেছি। অনেক মালিক এটা নিতে চান। প্রধানমন্ত্রীও মালিকদের এ হারে ঋণ দেওয়ার জন্য বলে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো মালিক শর্তের কারণে এ ঋণ নিতে পারেননি।'

No comments

Powered by Blogger.