রথম আলোর গোলটেবিল: পোশাক কারখানায় আগুন- মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকের অবহেলা

মালিকপক্ষের অবহেলাই তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আর তাই পোশাকশিল্প কারখানায় অগ্নিপ্রতিরোধব্যবস্থা নিয়মিত তদারকি এবং কারখানা ভবনে পর্যাপ্ত নির্গমন পথ (সিঁড়ি) রাখা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম আলো আয়োজিত ‘পোশাক কারখানায় আগুন: মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করুন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বুধবার বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, শুধু বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত ও মান (কমপ্লায়েন্স) পরিপালন নয়, বরং শ্রম আইন ও ভবন নির্মাণবিধিসহ স্থানীয় আইনগুলো প্রতিপালনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অন্যদিকে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষকে গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানান বৈঠকে অংশ নেওয়া পোশাকশ্রমিকেরা। তাঁরা মনে করেন, নির্গমন পথ খুলে না দেওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের সময় শ্রমিকেরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাই এত শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিখাইল শিপার, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) মাহবুবুর রহমান, জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি শিরীন আখতার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার, তাজরীন ফ্যাশনসের কর্মী মাবিয়া আক্তার, সৈয়দ আশরাফুল জামান ও রোকেয়া বেগম এবং নিট এশিয়া গার্মেন্টসের কর্মী মাহবুব আলম। এতে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
মালিকপক্ষই দায়ী: অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য মালিকপক্ষকে দায়ী করেন গোলটেবিলে অংশ নেওয়া কারখানার কর্মীরা।
মাবিয়া আক্তার বলেন, ‘কারখানা বন্ধ করতে চাইলে মালিক তা বললেই পারতেন।’ কারখানা বন্ধ করতে চাইলে শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের তিন মাস ১৩ দিনের বেতন দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মালিকপক্ষ তা দিতে চায় না বলেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
কারখানাটির আরেক কর্মী সৈয়দ আশরাফুল জামান বলেন, ‘আমি পাঁচতলায় কাজ করছিলাম। ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়ার পর উৎপাদন ব্যবস্থাপক দুলালকে জানাই। তখন তিনি আমাদের গালিগালাজ করে বসে কাজ করতে বলেন। এর দুই-তিন মিনিট পর ধোঁয়ায় সারা ঘর ভরে যায়। মানুষের চিৎকার-হাহাকার শুনতে পাই।’ আগে বের হতে দিলে এত মানুষের প্রাণ যেত না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেন আমাদের আগে বের হতে দেওয়া হলো না?’ একইভাবে আগুন লাগার পর কারখানা ব্যবস্থাপক রাজ্জাকও তাঁদের বের হতে না দিয়ে বরং গালিগালাজ করেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
মাহবুব আলম বলেন, ‘যখন কোনো বিপদ আসে, বিশেষ করে আগুন লাগে, তখন কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বেরিয়ে আসতে বাধা দেন। কারখানার ভেতরে ঢুকলে মনে হয় আমরা কয়েদি।’
রোকেয়া বেগম বলেন, ‘জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কাজ করি। আগুন লাগার পর চারতলা থেকে কীভাবে নেমে এসেছি বলতে পারব না।’
নাজমা আক্তার বলেন, ‘এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পড়ে। গোডাউন বানিয়ে শ্রমিক মারা হয়েছে।’ এ জন্য মালিকের বিচার চেয়ে গ্রেপ্তার দাবি করেন এই শ্রমিক নেত্রী। অগ্নিকাণ্ডের সময় মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বেরিয়ে আসতে বাধা দেন উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, এসব কর্মকর্তা কি মালিকপক্ষের বাইরে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, কারখানায় শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। ন্যূনতম কমপ্লায়েন্স মানা হলে একটি মৃত্যুও হতো না। কারখানার সিঁড়িগুলো বিকল্প সিঁড়ি নয়। আর জানালাগুলো বাইরের দিকে গ্রিল দিয়ে বন্ধ রাখা হয়। ধোঁয়ার কারণে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ধোঁয়া থেকে শ্রমিকদের দুই ঘণ্টা বাঁচানো সম্ভব হলে হয়তো এত মৃত্যু হতো না।
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের মতে, তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় নির্গমনের জন্য তিনটি সিঁড়ি পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের কথা বারবার আসছে। আমি ভেতরের কারণ জানতে চাই। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। সতর্কসংকেত বেজেছে, অথচ মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকেরা শ্রমিকদের বাধা দিয়েছেন। এখানে কার গাফিলতি? এর পেছনের হোতাদের বের করা উচিত।’
শিরীন আখতার বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যদি কর্মকর্তারা দায়ী হন, তাহলে মালিক বা উদ্যোক্তারাও সমানভাবে দায়ী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে শ্রম আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ঘটনার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
শ্রমসচিব বলেন, যেকোনো স্থানে আগুন লাগতে পারে। এ জন্য দ্রুত নির্গমন পথ থাকা উচিত। আইনে আছে, কারখানার কোনো গেট তালাবদ্ধ রাখা যাবে না—এ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু মালিকদের মধ্যে আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারা যেন মালিকদের টেন্ডার নিয়ে বসেছেন।’
ভবন নির্মাণবিধি মানা হয় না: মাহবুবুর রহমান জানান, যেকোনো শিল্পকারখানার অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। আবার ভবন তৈরির পরও অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। কিন্তু সিংহভাগই তা নেয় না।
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সরকার এখন বলছে, একটি সিঁড়ি রয়েছে এমন সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে শুধু সিঁড়ির সংখ্যা দিয়ে আগুন প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ভবন নির্মাণবিধি মানাই বড় কথা।’
তদারকির লোকবল নেই: মিখাইল শিপার জানান, ১৯৬২ সালের জনবলকাঠামো অনুযায়ী প্রধান কারখানা পরিদর্শকের কার্যালয়ে ৩১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। বর্তমানে মাত্র ১৮৪ জন কর্মচারী রয়েছেন। এই লোকবল বাড়ানো দরকার। শ্রমসচিব আরও জানান, গত মঙ্গলবার তাজরীনের মালিকের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের আওতায় মামলা করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, যে লোকবল রয়েছে, তাতে একটি কারখানা পরিদর্শনের পর আবার সেই কারখানা পরিদর্শনে যেতে দুই বছর সময় লাগবে। অথচ এই ধরনের পরিদর্শন নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন।
মাহবুবুর রহমান জানান, দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার কারখানা রয়েছে। অথচ ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালুর পর এ পর্যন্ত ৯৬টি কারখানার মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।
পোশাকি কমপ্লায়েন্স: গোলটেবিলে অংশ নেওয়া পোশাকশ্রমিকেরা কারখানা ভবনে পোশাকি কমপ্লায়েন্স দেখানো হয় বলে জানান।
নাজমা আক্তার বলেন, বিদেশি ক্রেতারা এলেই রঙিন নতুন টি-শার্ট পরিয়ে অগ্নিপ্রতিরোধ মহড়া দেওয়া হয়। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব পণ্যের দাম বাড়ে, সেটা মালিকেরা বিবেচনায় আনেন না। মজুরি কম বলেই শ্রমিককে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এক লাখ টাকা কি আমাদের জীবনের দাম? যদি ইচ্ছা করেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শ্রমিকেরা কেন বের হতে পারবেন না?’
ইকবাল হাবিব বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স নিয়ে মালিকদের অনেক আগ্রহ। কিন্তু শ্রমিকদের কমপ্লায়েন্স নিয়ে তেমন কাজ করা হয় না। তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্স নিয়ে সরকার একটি কমিশন গঠন করতে পারে। আর কমিশন কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে বাধ্য করবে।
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স বিদেশি ক্রেতাদের থেকে এলে হবে না। এটা আমাদের কাজ। আমাদেরকেই করতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.