হলিউড- লিঙ্কন স্পিলবার্গের সেরা ছবি?

চোখজোড়া রাজ্যের বিষণ্নতা। জানালা দিয়ে উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে, বাইরের প্রাকৃতিক শোভা মোটেও টানছে না তাঁকে। কুঁচকে আছে ভ্রু। কপালে চিন্তার ভাঁজ। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। গৃহযুদ্ধ শেষের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হচ্ছে আরেক যুদ্ধ।
এ যুদ্ধ নৈতিকতার। মানবিক অধিকারের। এ যুদ্ধ প্রকৃত গণতন্ত্রের। ১৮৬৩ সালের ‘ইম্যানসিপেশন প্রক্লেমেশন’ দাসদের মুক্তি দিলেও আসল মুক্তি ঠিক মেলেনি। তখনো যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা ঠিক অবৈধ নয়। অন্তত আইনের চোখে। লিঙ্কনের জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ এটাই। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সংবিধানে তিনি আনতে চান সংশোধন। শ্বেতাঙ্গদের একচেটিয়া আধিপত্যের মার্কিন সমাজে যে কাজ অসম্ভবের কাছাকাছি। লিঙ্কন পারবেন?
পেরেছেন! ইতিহাস তারই সাক্ষী। কিন্তু চাঁছাছোলা ইতিহাসে মানবিক আবেগের স্থান নেই। নেই টানাপোড়েনের জলছবি। মলাটবন্দী গোটা গোটা কালো অক্ষরের সাধ্য নেই আব্রাহাম লিঙ্কনের আসল ছবি আঁকে। ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনতে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন লিঙ্কন, একই রকম বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী, বিশেষ করে দাসপ্রথা বিলোপে তাঁর সেই আলোচিত সংশোধনীর সময়টা নিয়ে বানিয়েছেন ছবি। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ১৫০ মিনিটের লিঙ্কন ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই বলছেন, চ্যালেঞ্জটায় দারুণভাবে জিতেছেন স্পিলবার্গ, যেমন জিতেছিলেন লিঙ্কনও।
আসছে বছর ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন স্পিলবার্গ। এই দীর্ঘ পাঁচ দশকে কম আলোচিত ছবির জন্ম দেননি। সিন্ডলারস লিস্ট (১৯৯৩) আর সেভিং প্রাইভেট রায়ান (১৯৯৮) তো সেরা পরিচালকের অস্কার এনে দিয়েছে তাঁকে। আছে ই.টি., জোস, জুরাসিক পার্ক-এর মতো দুর্দান্ত ছবি। ইন্ডিয়ানা জোন্স-এর মতো সফল সিরিজ। আছে মিউনিখ অলিম্পিকের সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে বানানো মানবিক আখ্যান মিউনিখ। স্পিলবার্গ আসলেই যেন এক পরশপাথর। যেখানে হাত দিয়েছেন নিশ্চিতভাবে সোনা ফলেছে। এমনকি অ্যানিমেশন ছবি অ্যাডভেঞ্চার অব টিনটিন দিয়েও কাঁপিয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্রের দুনিয়া!
তবে অনেকেই বলছেন, ৬৫ বছর বয়সে এসেই নিজের সেরা ছবিটা বানিয়েছেন স্পিলবার্গ। আগামী অস্কারে এই ছবি তাঁকে তৃতীয়বারের মতো সেরা পরিচালকের পুরস্কার এনে দেবে বলেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। শুধু স্পিলবার্গ নন, লিঙ্কন চরিত্রে অবিশ্বাস্য অভিনয় করা ড্যানিয়েল ডে-লুইস সেরা অভিনেতার পুরস্কারটিও বাগিয়ে নেবেন বলেই সবার অনুমান।
লিঙ্কনকে নিয়ে ছবি বানানোর পরিকল্পনাটির বয়স প্রায় এক যুগ। কিন্তু কিছুতেই চিত্রনাট্য পছন্দ হচ্ছিল না স্পিলবার্গের। প্রথমে দুজন লিখেছেন ছবির চিত্রনাট্য। জন লোগান আর পল ওয়েব। এই দুজনের পর চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেন টনি কুশনার। শেষ পর্যন্ত তাঁর চিত্রনাট্যেই নির্মিত হয়েছে ছবিটি। কৌতুকের আড়ালে কুশনার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই কাজ করতে গিয়ে কী হাড়ভাঙা খাটুনিই না খাটতে হয়েছে। ২০০৮-এর দিকে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ নিয়ে আমি আব্রাহাম লিঙ্কনের ওপর ৯ লাখ ৬৭ হাজারতম বইটা পড়ছি।’
স্পিলবার্গ বড্ড খুঁতখুঁতে—পারফেকশনিস্ট। সেটাই তাঁকে ‘স্পিলবার্গ’ বানিয়েছে। লিঙ্কন তাঁকে আরেক উচ্চতায় নিয়ে যাবেই বলে বলছেন বোদ্ধারা। স্পিলবার্গ অবশ্য এতশত ভাবছেন না। নিজের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ করতে পারার তৃপ্তিই আপাতত তাঁর সঙ্গী। ছবিটা নিয়ে তিনি ব্যবসা করতে চাননি। শুরুতে মাত্র ১১টি থিয়েটারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও লিঙ্কন আয় করেছেন দুর্দান্ত। পরে দুই হাজারের মতো হলে মুক্তি পায়। ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ছবিটির প্রায় চার কোটি ডলার আয় আরও একবার প্রমাণ করে দিল, ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর ছবির মধ্যেও যে দর্শকদের বার্তার পাশাপাশি বিনোদনও দেওয়া যায়, স্পিলবার্গের চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝি জানে না!
 রাজীব হাসান
এলএ টাইমস ও হলিউড রিপোর্টার অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.