এক রাস্তা অনেক দৌড় by অমিত বসু

কাঠঠোকরা যেভাবে গাছ ঠোকরায়, দেখলে ভয় হয়। মেশিনেও সেটা সম্ভব নয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়ে ১২০০ গুণ বেশি জোরে। ঠোকরানোর সময় চোখ বুজে নেয়। তা না হলে মণি দুটি ছিটকে বেরিয়ে আসত। এত কষ্ট করে ঠুকরে যে কোনো লাভ হয়, তা-ও নয়।
তারা কাঠ খায় না, কাঠের ঘরও বানায় না। অকারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাছকে যন্ত্রণা দেয়। অবিশ্রান্ত একে-ওকে ঠোকর রাজনীতিতেও। কর্কশ শব্দ নিঃসরণে কান ঝালাপালা। মানা করলে শুনছে কে? আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে করে নির্নিমেষ শব্দদূষণ। বিজেপি সভাপতি নীতিশ গড়করির ওষ্ঠ-অধরের বিরক্তিকর প্রলাপে চিরস্থায়ী অন্ধকার। রাজনীতির বাইরে থাকা কল্যাণময় ব্যক্তিত্বকেও রেয়াত করতে চান না তিনি। আঘাত করেছেন স্বামী বিবেকানন্দকেও। বলেছেন, বিবেকানন্দ আর মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের বুদ্ধিবৃত্তি এক। কাজে লাগিয়েছেন ভিন্নভাবে। তফাৎ শুধু এটাই। না ভেবে এ কথা তিনি বলেননি। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। কিছুটা সাম্প্রদায়িক উস্কানি, বাকিটা রাজনীতি। অবৈধ সম্পদ আহরণের অভিযোগে তিনি কলঙ্কিত। দাগ ধুতে আপ্রাণ চেষ্টা। আপাতত বিতর্কের আড়ালে গা-ঢাকা দেওয়ার প্রয়াস। বিবেকানন্দের শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে ভাষণের কথা উল্লেখ করতে পারতেন। সেখানে তিনি বিশ্ববাসীকে আমার ভাই-বোন বলে সম্বোধন করেছেন, যা মুগ্ধ করেছে সব ধর্মের প্রতিনিধিদের। দীর্ঘ করতালিতে তারা অভিনন্দিত করেছেন বিবেকানন্দকে। যে বাণী আজও বারবার উচ্চারিত হওয়া জরুরি। সে দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে বিকৃত ভাবনা। ১৯০২-এ মৃত্যুর আগে মাকে নিয়ে ঢাকা সফর করেছিলেন বিবেকানন্দ। নৌকায় পদ্মা বেয়ে শহরে পেঁৗছেই তিনি আপ্লুত। মানুষের সঙ্গে মিশেছেন আন্তরিকভাবে। আড্ডা দিয়েছেন প্রাণখুলে। তার আপ্তবাক্য ছিল একটাই_ যত মত তত পথ। সবার অবদানে পৃথিবী সুন্দর হবে।
কমিউনিস্টরা পর্যন্ত বিবেকানন্দকে মানতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্বজুড়ে পিছিয়ে পড়া মানুষকে যখন এগিয়ে আনার ডাক দিয়েছিলেন তিনি, তখনও রুশ বিপ্লব হয়নি; চীন বিপ্লব তো দূরের কথা। গড়করি সেই বিবেকানন্দকেই আক্রমণের টার্গেট করলেন। বাঁচার রাস্তা খুঁজতে এটাই তার অস্ত্র। বিজেপি সভাপতির পদে তার মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তার আগেই তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা হচ্ছে। নামাতে চাইলেই তিনি নামবেন কেন? মাথা নিচু করে হার মানতে নারাজ। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দাবিয়ে রাখতে তিনি জাল বিছাচ্ছেন। নিজের রাজ্যে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত মোদি। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক জাহির করতে বিবেকানন্দের শরণাপন্ন। বিবেকানন্দের ছবিতে, পোস্টারে ভরে দিয়েছেন রাজ্য। মানুষ আশ্বস্ত। মুসলিম ভোটব্যাংক নিয়ে আতঙ্কের কারণ নেই। গড়করি বুঝলেন, বিবেকানন্দকে টেনে নামাতে না পারলে মোদিকে জব্দ করা যাবে না। বিবেকানন্দকে দাউদ ইব্রাহিমের সমতুল্য করে তুলতে পারলে একসঙ্গে দুটি কাজ হবে। হিন্দুরা চটবে, মোদির নিশ্চিত ভোট কাটবে। মুসলমানরা দ্বিধান্বিত হবে, মোদির পক্ষ থেকে সরে দাঁড়াবে। এমনিতে তারা ত্রুক্রদ্ধ। গোধরা কাণ্ডের গভীর ক্ষত এখনও দগদগ করছে তাদের হৃদয়ে। মোদি মলম লাগিয়েছেন বারবার। শুকায়নি একটুও। এ ঘা যে সারার নয়_ মোদি জানেন। তার লক্ষ্য, শিল্পায়নের আলোয় অতীত অন্ধকার মুছে দেওয়া। তাও কি সম্ভব? বিবেকানন্দের মূর্তির আড়ালে লুকালে পার পাবেন। কলকারখানার ধোঁয়ার চেয়ে কালো কালি মেখে তিনি বসে আছেন।
গুজরাটে কৃষকদের ক্ষোভও বাড়ছে। তাদের দিকে নজর নেই মোদির। সেচ নেই, সার নেই; সস্তায় বীজ নেই; বাজারে কৃষিপণ্যের দাম নেই। জীবন উদযাপন যন্ত্রণার। অনেকে সয়েছে, আর নয়। এবার প্রতিবাদী। মোদি প্রতিশ্রুতির টোপ দিচ্ছেন, সে টোপ তারা গিলছে না। এমন দুরবস্থাতেও মোদি জিততে মরিয়া। না জিতলে ক্যারিয়ার শেষ। তার একমাত্র ভরসা সঙ্ঘ পরিবার। তাতেই হাত কামড়াচ্ছেন গড়করি। সঙ্ঘ পরিবারকে তিনি পাশে চান। আরএসএস গড়করির হাত ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। সম্পত্তির বৈধতা নিয়ে গড়করির বিরুদ্ধে প্রশ্নের ঝাঁঝ তীব্র হতেই তারা সরে দাঁড়িয়েছে। দাগি লোককে সামনে রাখতে তাদের আপত্তি। মৌলবাদের ধর্মই তাই। ওয়ারফ্রন্টে থাকবে সেরা লোক। বেদাগ, ব্রিলিয়ান্ট; যাকে দেখে লোকে সমীহ করবে। বলবে, এই না হলে নেতা! শিক্ষায়তনে কড়া নজর। দুধ থেকে মাখন তুলে নাও, শিক্ষা দাও যত্ন করে, তারপর কাজে লাগাও। সঙ্ঘ পরিবার মনে করছে, আলুর বস্তায় পচা আলু গড়করি। তাকে বের করে ছুড়ে ফেলাই ভালো। না হলে মৌলবাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে যাবে।
বেকায়দায় গড়করি। ডানা ছাঁটা পাখির মতো করুণ অবস্থা। উড়তে চাইলেও ওড়ার উপায় নেই। তাই বলে স্বপ্ন জলাঞ্জলি কখনও নয়।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.