রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক- শিশু অপহরণ, হত্যা-মুক্তিপণ দাবি: শেষ কোথায়?

১৭ নভেম্বর প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘শিশু অপহরণ, হত্যা-মুক্তিপণ দাবি: শেষ কোথায়?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গোলটেবিলের আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো এই ক্রোড়পত্রে
যাঁরা অংশ নিলেন
মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
হামিদা হোসেন
চেয়ারপারসন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
আলী ইমাম মজুমদার
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
কাজী জিয়া উদ্দিন
এআইজি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স
সালমা খান
সাবেক চেয়ারপারসন, জাতিসংঘ
সিডও কমিটি ও নারী অধিকার কর্মী
এ আই মাহবুব উদ্দীন
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও
পরিচালক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস প্রোগ্রাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কামরুন নাহার
অপহরণের পর নিহত শিশু
শেখ ফরিদের মা

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সুমনা শারমীন
ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
যেকোনো অপহরণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের নিখোঁজ, অপহরণের ঘটনা দেখি। অপহরণের পর মুক্তিপণ। একটি মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি পরাগ মণ্ডলের অপহরণে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মায়ের সঙ্গে নিজেদের গাড়িতে স্কুলে যাওয়ার সময় অপহূত হলো পরাগ। গুলিবিদ্ধ হলেন মা, বোন, গাড়িচালক। ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার। এই নৃশংসতা থেকে আমাদের কি মুক্তি নেই? অভিযুক্ত অপহরণকারীদের দুজন জেলে ছিল। কয়েক মাস আগে তাদের নানা কৌশলে জামিনে বের করে আনা হয়েছে। পুলিশের উচিত ছিল আদালতের কাছে আবেদন করা, যেন চিহ্নিত অপরাধীদের সপ্তাহে দু-তিন দিন থানায় বাধ্যতামূলক হাজিরা দিতে আদেশ দেওয়া হয়। জামিনের পর তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো এত সহজে ওরা অপহরণের সুযোগ পেত না। এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন মিজানুর রহমান।

মিজানুর রহমান
কোনো সভ্য রাষ্ট্রে একজন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্রকে জবাব দিতে হয়। দেশে যে পরিমাণে অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে, তার জন্য রাষ্ট্র কতটুকু করছে বা রাষ্ট্রের কী করা উচিত, স্পষ্ট নয়। পৃথিবীর কোনো মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। দেশে খুব সাধারণ কারণে মানুষ মানুষকে খুন করছে। অপরাধের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য অপরাধ হয়ে থাকে। আইনের শাসনের অভাবে অপরাধের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে অন্যায় অপরাধের পরিমাণ যত বেড়েছে, দেশে আইনের শাসন তত কমেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নানামুখী প্রভাবের কারণে অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। সবাই দেখেছেন, এ পর্যন্ত কতজন মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি ছাড়া পেয়েছে। এরা যখন ছাড়া পায়, তখন দায়মুক্তির যে অপসংস্কৃতির কথা বলা হয়, পরোক্ষভাবে একে উৎসাহিত করা হয়। নতুন অপরাধ সংঘটিত হতে সাহায্য করে। হত্যা, গুমসহ পরাগ মণ্ডলের অপহরণের ঘটনার মতো নৃশংস ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। মুক্তিপণ দাবির সৎ ও অসৎ দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি জুলুমকারী দেশের কোনো নাগরিককে আটক করে কিছু ভালো মানুষের মুক্তির দাবি সমর্থনযোগ্য। অসৎ উদ্দেশ্যে মুক্তিপণ কোনো সমাজ, রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না; যেমনটি ঘটেছে পরাগ মণ্ডলের ক্ষেত্রে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশ্ন করতে হবে, তারা কেন পারছে না। সম্প্রতি এ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করছি। পরাগ অপহরণের মূল আসামিদের কেন এখনো ধরতে পারছে না। অপরাধী চক্র কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আজ না হোক কাল তাদের জবাব দিতেই হবে। জাতির করের পয়সায় বেতন-ভাতা নেবে, অথচ তাদের জন্য কাজ করবে না, তা হবে না।

সুমনা শারমীন
এ বছরের মার্চে ফরিদকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় ১০ লাখ টাকা জোগাড় করে মা অপেক্ষা করেছিলেন সারা রাত। অতঃপর কবরস্থানে পাওয়া যায় ফরিদের লাশ। আবার পরাগ অপহরণ। বেড়েছে পরিবারে পরিবারে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ। কোনো মা-বাবা সন্তান নিখোঁজের মতো ঘটনা সহ্য করতে পারেন না।
যেকোনো মূল্যে সন্তানকে ফিরে পেতে চান। আর এই কৌশলই হয়তো কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। ২০১১-১২ সালে প্রকাশিত শুধু প্রথম আলোতেই এ রকম ২০টি ঘটনার প্রতিবেদন খুুঁজে পাওয়া গেল।
এমন অনেক ঘটনা আছে, যা পত্রিকার অফিস পর্যন্ত আসে না। এবার শুনব হামিদা হোসেনের কাছ থেকে।

হামিদা হোসেন
অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদের প্রতি লোভ মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলছে। রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে অপরাধী চক্র তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা-যোগ্যতার কোনো মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। নিয়োগপ্রার্থী গোপালগঞ্জের, না বগুড়ার সেটাই তাঁদের যোগ্যতা। পাঁচ বছর গোপালগঞ্জের পুলিশ, আবার পাঁচ বছর বগুড়ার পুলিশ—এভাবেই চলছে। এ ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আইনের শাসন চালানো সম্ভব নয়। ইদানীং আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। অবিলম্বে এ বাহিনীতে দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ না দিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা কথা বলেন বেশি, কাজ করেন কম। একে ধরব, তাকে ধরব—কত কথা। শেষে কোনো কিছুই হয় না। তাঁদের উচিত আগে কাজ করে পরে কথা বলা। আমাদের সময় সন্তানদের কোথাও নিয়ে যেতে হতো না। তারা নিজেরাই সবকিছু করতে পারত। এখন সন্তানদের বহু রকম বিধিনিষেধের মধ্যে চলতে হচ্ছে। ফলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সুমনা শারমীন
শিশুদের অপরাধ, তাদের বাবার টাকা আছে। জমি আছে। কিংবা বাবা প্রবাসী। শেখ ফরিদের বাবা সিঙ্গাপুরে থাকেন। আজও ফরিদের মায়ের কান্না থামেনি। সেই মা আমাদের মাঝে আছেন। এখন বলবেন ফরিদের মা কামরুন নাহার।

কামরুন নাহার
সেদিন সকালবেলা ফরিদ ঘুম থেকে উঠেছে। বললাম, হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলের জন্য তৈরি হও। ও বলল, ‘আম্মু, আজ না গেলে হয় না। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না।’ বললাম, বাবা, লেখাপড়া করলে অনেক বড় হবা। স্কুলে যাও। গেল। বেলা একটা বাজে, ফরিদ তখনো ফিরে আসেনি। খোঁজখবর শুরু করলাম। স্কুলের খাতায় ফরিদের নাম নেই। চিৎকার করে কান্না করতে থাকলাম। বারবার ফরিদের কথা কানে আসছে, ‘আম্মু, আজ না গেলে হয় না। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না।’ ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটছে। বিকেলবেলা ফোন এল। প্রথমে ওর দাদা কথা বলল। তারপর আমি। ও পাশ থেকে বলছে, ‘তোর পোলারে ধইরা আনছি। ১০ লাখ টাকা দিলে ছাড়া পাইবি।’ বললাম, আমার ছেলের বিনিময়ে ১০ লাখ, ২০ লাখ যত টাকা চাও দেব। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় সর্বস্বান্ত হয়ে টাকা জোগাড় করেছি। তাদের কথামতো কাজ করেছি। সারা রাত টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার বুকের মানিককে নিয়ে কেউ ফিরে আসেনি। পরে কবরস্থানে মাটিচাপা অবস্থায় সন্তানকে পেয়েছি। আমার ছেলেটাকে অনেক অত্যাচার করে মেরেছে। তার শরীরে ক্ষতচিহ্ন দেখেছি। ফরিদ মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। রাত হলে দুই চোখ ভেঙে কান্না আসে। প্রতি রাতে বিছানায় শুয়ে কাঁদি। ফরিদের শেষ কথা কোনো দিন মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। কেবলই শুনি, ‘আম্মু, আজ না গেলে হয় না। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না।’ সব সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
স্থানীয় নেতাদের কাছে বিচার দিয়েছি। থানায় মামলা করেছি। প্রথম দিকে থানা কিছুটা তৎপর ছিল। পরে ছেলের অপহরণকারীরা থানায় অনেক টাকা দেয়। তখন থেকে থানা হত্যাকারীদের পক্ষ নিয়েছে। আমরা গেলে কথা বলে না। উল্টাপাল্টা কথা বলে একটা কিছু বুঝিয়ে দেয়। কোনো বিচার না পেয়ে প্রথম আলোর কাছে বলেছি। থানা এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়েছে। চোখের সামনে অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায়। কিছুই করতে পারছি না। থানা, স্থানীয় লোকজন সবাই জানে, কে ফরিদকে হত্যা করেছে। কারা সঙ্গে ছিল। এর পরও আমরা বিচার পাচ্ছি না।
কারও কাছে কোনো চাওয়া নেই, দাবিও নেই। শুধু একটাই চাওয়া—আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে, তাদের যেন বিচার হয়। আপনাদের সবার কাছে অনুরোধ, শুধু আমার ছেলের বিচারটা করে দিন। আমার আর অন্য কোনো দাবি নেই।

সুমনা শারমীন
পরিবারের কান্না শেষ হয় না। আমরা জানি না শিশুদের অপহরণের এই অপরাধের শেষ কোথায়? কিন্তু শেষ হওয়াটা জরুরি। এবার শুনব সালমা খানের কাছ থেকে।

সালমা খান
গতকাল ডেইলি স্টার-এর একটি পরিসংখ্যানে দেখলাম, গত দুই বছরে ১৫৬ জন অপহরণ বা নিখোঁজ হয়েছে। একটি সভ্য রাষ্ট্রে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ঘটনা কোনোভাবেই মানা যায় না। দেশে আইন আছে, পুলিশ আছে। তার পরও এসব ঘটছে। যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের যদি হত্যা করা হয়, তা-ও তার পরিবার জানবে না। তারা সারা জীবন এদের ফিরে আসার অপেক্ষা করবে। অথচ মানুষটি কোনো দিন ফিরে আসবে না। এর থেকে কষ্টের, বেদনার আর কিছু আছে কি না, জানি না। অন্য দেশে তো এ রকম ঘটনা দেখা যায় না। এ থেকে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা অকার্যকর।
পরাগ মণ্ডল অপহরণের পর টেলিভিশনে আমরা তার মা-বাবার গভীর উদ্বেগের ছবি দেখেছি। যেকোনো পরিবারের শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ অপহরণ হোক, সারা জীবন সেই পরিবারকে উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয়। অপহরণ, নিখোঁজের বিষয়টি জাতিসংঘ অনেক গুরুত্ব দেয়। ১৯৯৭ সালে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে জাতিসংঘ একটি কমিটি করে। কোনো দেশের নাগরিক নিখোঁজ, গুম, অপহূত হলে তাদের পরিবার থেকে জাতিসংঘের এই কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারে। জাতিসংঘ বিষয়টি এতটা গুরুত্ব দেয় যে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো চুক্তিরও প্রয়োজন নেই।
৪০ বছর যাবৎ অপরাধের মধ্যে আছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। সন্ত্রাসীরা এত সহজে অর্থ বানানোর পথ ছাড়বে কেন? তারা জানে, আয়ের কিছু টাকা বণ্টন হবে, অবশিষ্ট সবই তাদের থাকবে। জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামি, দাগি আসামি, সন্ত্রাসী চক্র সবাই মিলে এগুলো করছে। স্থানীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, পুলিশ সবই জানে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না। একজন অপরাধীর অপরাধের যখন বিচার হয় না, তখন সে আরও বড় থেকে বড় অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। পরাগ মণ্ডলের অপহরণকারী হয়তো কোনো সন্ত্রাসের মামলায় জামিনে আছে। জামিনে থাকার পর এত বড় অপরাধ করেছে। অর্থাৎ, সে ধরে নিয়েছে, যা-ই করুক তাকে ধরা হবে না। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এই সাহস কীভাবে পায়, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
দেশে যথেষ্ট ভালো আইন আছে। কিন্তু আইনের শাসনের অভাবে অপরাধীরা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফরিদের মায়ের কথা শুনলাম। তিনি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারেননি। এটি দেশের জন্য খুব আতঙ্কের বিষয়। সিঙ্গাপুরে সি বিচে মেয়েদের গভীর রাতে কাজ করতে দেখেছি। একজনকে প্রশ্ন করলাম, তোমাদের বাসায় ফিরতে অসুবিধা হয় না? সে বলল, ‘আমাদের দেশে আইন আছে। তোমাদের নেই?’ বললাম, আছে। কিন্তু...।

সুমনা শারমীন
মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসুক। সন্তানদের নিয়ে দূর হোক অভিভাবকদের উদ্বেগ। এখন বলবেন আলী ইমাম মজুমদার।

আলী ইমাম মজুমদার
একটি সমাজে অপরাধ হতে পারে। কিন্তু অপরাধীর বিচার হতে হবে। দেশে অপরাধীরা বীরের মতো ঘুরে বেড়ায়। সাজা না হলে রাষ্ট্রে ভয়ংকর অপরাধ হতে থাকে। তাই যেকোনো মূল্যে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২০০১ সাল থেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়। রাজনৈতিক মামলার অজুহাতে হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই সুযোগে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহার হওয়ায় তারা সমাজে আবার নতুন উৎসাহে অপরাধজগৎ গড়ে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। কোথাও কোথাও বলে দেওয়া হয়, ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পারে না, এমন কাজ নেই। বাংলা ভাইদের মতো কুখ্যাত অপরাধীকে তারা ধরেছিল। এদের কাজ করতে দেওয়া হয় না। সুযোগ পেলে এ বাহিনী সব করতে পারে।
দেশে দ্রুত একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা চলে আসছে। ফলে কোনো ঘটনারই সমাপ্তি টানা যাচ্ছে না। পত্রিকা অফিসে একটা ঘটনা লিখে পাঠালাম। অফিস থেকে ফোন করে বলা হলো নতুন করে লেখা পাঠানোর জন্য। সরকার ও রাজনৈতিক দল আলাদা, বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে। শুধু বুঝলেই হবে না, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
কেরানীগঞ্জের পরাগকে টাকা দিয়ে উদ্ধার করা হলো। কে টাকা নিয়ে গেল, কে গ্রহণ করল, কোথায় নিল, কত টাকা নিল—পুলিশ কেন এগুলো বের করতে পারল না? টাকা লেনদেনের আগে থেকেই এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছিল। এখন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, পুলিশ সবাই যদি মানুষের জন্য কাজ না করে, তাহলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে।

সুমনা শারমীন
অপরাধ নির্মূলে জনগণ, রাজনৈতিক দল, পুলিশ, প্রশাসন কেউ কারও প্রতিপক্ষ হওয়ার কথা নয়। এবার বলবেন এ আই মাহবুব উদ্দীন।

এ আই মাহবুব উদ্দীন
যদি প্রশ্ন করেন, অপরাধ কেন ঘটে? এর উত্তর হবে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য অপরাধ সংঘটিত হয়। আইনের শাসনের অভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়। আজকের যুগে দ্রুত অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া দ্রুত পাল্টে গেছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দুর্নীতি যুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত দায়িত্বশীল মানুষ যখন চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন করে অর্থ সঞ্চয় করে; তখন অপরাধীদের কাছে অপরাধের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টি খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
অস্থির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সমাজব্যবস্থায় একটি নতুন ধারণা তৈরি হয়েছে। এ ধারণায় মূল্যবোধ, আদর্শ, বিশ্বাস কোনো কিছু কাজ করছে না। পুরোনো মূল্যবোধ, বিশ্বাসও কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনাচারের মধ্যে তরুণদের মাঝে নতুন ভাবনা তৈরি হচ্ছে। এদিকে বিশ্বায়নের ফলে মাফিয়া ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার, প্রশাসন সবার যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে একটি সুন্দর সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব।

সুমনা শারমীন
আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে অনেক দক্ষ মানুষ আছেন। সঠিক নির্দেশনা পেলে তাঁরা যেকোনো অপরাধীকে ধরতে পারেন। আর একটি বিপদগ্রস্ত পরিবার তো তাঁদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। এখন শুনব কাজী জিয়া উদ্দিনের কথা।

কাজী জিয়া উদ্দিন
পরাগ অপহরণের বিষয়টি পুলিশ প্রশাসন খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান কাজ ছিল তাকে উদ্ধার করা। প্রথম কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। অপহরণকারী ইতিমধ্যে আটক হয়েছে। নিরাপত্তার কথা, অপরাধের কথা আলোচনায় এসেছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর এ দেশে বহুমাত্রিক অপরাধ সংঘটিত হয়।
পুলিশের একার পক্ষে সব ধরনের অপরাধ প্রতিহত করা কঠিন। অপরাধ মোকাবিলা ও সমাজটাকে সুন্দর করার জন্য সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম আছে। একশ্রেণীর মানুষ শ্রম না দিয়ে অর্থ উপার্জনের দিকে ছুটছে। একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘আলী বাবা লড়েছেন চল্লিশ চোরের সঙ্গে। আমাদের লড়তে হচ্ছে হাজার হাজার চোরের সঙ্গে।’ পুলিশকে সব সময় প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেকাজ করতে হয়। এ জন্য সবক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হয় না। সমাজের সব সম্ভাবনার সূচকের সঙ্গে সবাইকে যুক্ত করে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। শিক্ষার সঙ্গে দেশপ্রেমের বিষয়টি যুক্ত থাকলে অপরাধের মাত্রা কমে আসবে। সবশেষে বলতে চাই, আমরা আপনাদের পাশে আছি, থাকব। দেশটা আমাদের সবার। সবাই হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাই।

সুমনা শারমীন
এতক্ষণ সবার আলোচনা শুনলাম। অনেকে আরও কিছু হয়তো বলতে চান। প্রত্যেকে দু-এক লাইনের মধ্যে যদি কিছু বলেন।

কামরুন নাহার
আমার আরেকটি ছোট ছেলে আছে। তাকেও অপহরণের হুমকি দিচ্ছে। আট মাস ধরে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করেছি। ফরিদ হত্যার বিচার পাচ্ছি না। তার ওপর এ সন্তানটি হারানোর শঙ্কা। এভাবে হয়তো আর বেঁচে থাকা হবে না। কোথাও কোনো বিচার পাচ্ছি না। দিন-রাত কাটে চরম হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে। এখন কোথায় যাব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনাদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ, আপনারা শুধু ফরিদের বিচারটা করুন।
কেয়া আক্তার (কামরুন নাহারের মেয়ে, নিহত ফরিদের বোন): এতক্ষণ মায়ের কষ্টের কথা শুনেছেন। পরিবারে মা ছাড়া ভরসা করার মতো কেউ নেই। বাবা দেশের বাইরে থাকেন। মায়ের যদি কিছু হয়, আমাদেরও বেঁচে থাকা হবে না। মায়ের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, আপনারা আমার নিহত ভাই ফরিদের বিচারের ব্যবস্থা করুন।

হামিদা হোসেন
আমরা কামরুন নাহারের কথা শুনলাম। তিনি সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তার পরও পুলিশের কাছে যেতে চাননি। কারণ, তিনি মনে করেছেন, পুলিশকে টাকা দেওয়াসহ ঝামেলা আরও বাড়বে। এখন পুলিশকে ভাবতে হবে, কীভাবে তাদের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। এখানে পুলিশের এআইজি বলেছেন সবাইকে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা। মনে আছে, একবার ঢাকার মেয়র কমিউনিটিকে যুক্ত করার কথা বলে নিজস্ব ক্যাডারদের ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। মামলায় এত সময় লাগে যে মানুষ মূল ঘটনা একসময় ভুলে যায়। ফলে এ ধরনের অপরাধকে বিশেষ বিচারের আওতায় আনতে হবে।

আলী ইমাম মজুমদার
দ্রুত বিচার, স্বাভাবিক বিচার কোনোটাই ঠিকমতো হয় না। যেকোনো বিচার সঠিকভাবে হলে মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়ে। মনে পড়ে খুলনার ভয়ংকর সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের কথা। তাঁকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন সমাজে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। অপরাধীদের বিচার হওয়াটা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা যদি চান, তাহলে যে আইন আছে, সেটা দিয়েই সবচেয়ে সুন্দর সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব। বিহারের নিতিশ কুমারের কথা জানি। প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্য বিহারকে দুর্নীতিমুক্ত করেছিলেন তিনি। সমগ্র ভারতের দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত রাষ্ট্রের উদাহরণ হয়েছে বিহার। নিতিশ কুমার পারলে আমরা কেন পারব না? আমরা পারি না এ জন্য যে, নিতিশ কুমার মন থেকে চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্য হবে দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত। আমার সেটি চাই না।

সালমা খান
জনসাধারণ পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু আইন শেষ পর্যন্ত পুলিশকে প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশে কিছু হলে মানুষ বলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। স্বাভাবিক শাস্তি হয় না বলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলে। বিচার বিলম্ব করে বিচারকে অস্বীকার করার মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
প্রতিটি বিষয় দেশের মানুষকে সঠিক সময়ে জানানো হোক। সরকার এবং অন্যান্য দিক থেকে অযাচিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধরা হবে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার—এ ধরনের কথা বন্ধ করতে হবে। সব রকম মন্তব্য বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য সময়ের মধ্যে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গুলশানের একটি বাড়ি দখলের ঘটনার কথা জানি। সেখানে পুলিশকে আগে থেকেই আসতে নিষেধ করা হয়েছিল, যদিও ঘটনাটা ঘটতে পারেনি। এভাবে একটি দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না।

এ আই মাহবুব উদ্দীন
সঞ্চালক একটি প্রশ্ন করেছেন: এর শেষ কোথায়? উত্তর হচ্ছে, এর কোনো শেষ নেই। কারণ, অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি ও অর্থনীতি। যখন সমাজে অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে না, তখন অপরাধকে অর্থ উপার্জনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম, অর্থ বেশি।

কাজী জিয়া উদ্দিন
আমি খুব আশাবাদী। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে সমাজটা বদলে দিতে পারব। পুলিশকে যেকোনো শ্রেণীর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। পুলিশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমাজ যেভাবে চাইবে, পুলিশ তেমনই হবে। পুলিশ সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা থাকবে না। আমরা মানুষের জন্য কাজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সুমনা শারমীন
পরাগ অপহরণের ঘটনায় উদ্বেগ চারদিকে। পরাগ ফিরে এসেছে পরিবারে, যদিও পরিবারে পরিবারে সন্তানদের নিয়ে আছে নিরাপত্তাহীনতা। খুব অল্প সময়ের ডাকে আপনারা আজ এখানে এসেছেন, বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন।
এ আলোচনা থেকে যে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা উঠে এসেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে শিশু অপহরণ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা কমবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সময় দিয়েছেন।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.