তত্ত্বাবধায়কের দাবি না মানলে টানা হরতাল

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আগামী ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এসব কর্মসূচিতে সরকার যদি বাধা দেয় বা কোনোরকমের নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়, তাহলে হরতাল, অবরোধসহ সব ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে খালেদা জিয়া কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। আমরা মাত্র ১৩ দিন হরতাল করেছি। এখনো সময় আছে, তত্ত্বাবধায়কের দাবি না মানলে সেভাবেই আমাদের জবাব দিতে হবে। লাগাতার হরতাল পর্যন্ত যেতে হবে।’ এ জন্য নেতা-কর্মীদের ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নেওয়ারও আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ৬ ডিসেম্বর সারা দেশে ‘গণতন্ত্র মুক্তি’ দিবস পালন, ৯ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজধানীসহ সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভায় অবরোধ, ১২ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস উপলক্ষে দলীয় কর্মসূচি পালন, ২৩ ডিসেম্বর সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভ এবং ২৬ ডিসেম্বর সারা দেশে গণসংযোগ কর্মসূচি। ঢাকায় গণসংযোগ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন খালেদা জিয়া। ঢাকার বাইরে বিএনপি ও জোটের নেতারা থাকবেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ফিসফাস শোনা যায়, সরকার জরুরি অবস্থা দেবে। কিন্তু তা দিলেও কোনো কাজ হবে না। জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, জরুরি অবস্থা দিলেও তারা সবকিছু ভেঙে রাজপথে নেমে আসবে।
১৮ দলীয় জোটের এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে জোটের নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টন এলাকায় আসতে শুরু করেন। ঢাকার আশপাশের এলাকা ও বিভিন্ন জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পশ্চিমে কাকরাইলের মোড় এবং পূর্বদিকে ফকিরাপুল পর্যন্ত এলাকায় মাইক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত এ এলাকার বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন বিরোধী জোটের হাজার হাজার নেতা-কর্মী।
বেলা দুইটায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২টা থেকেই বক্তৃতা শুরু করেন বিএনপিসহ জোটের নেতারা। বেলা সোয়া তিনটায় নেতা-কর্মীদের তুমুল করতালি ও স্বাগত স্লোগানের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া মঞ্চে আসেন। এরপর আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ও চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে উড়ালসড়কের গার্ডার ভেঙে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
খালেদা জিয়া বিকেল সোয়া চারটায় বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দলীয়করণের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, দুদকের কথা এ দেশের মানুষ আর বিশ্বাস করে না। দুদক একটি মিথ্যাবাদী ও সরকারের পদলেহী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সরকার যা বলে, তা-ই করে। তারা বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। আর বিচার বিভাগ দলীয়করণ করায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দলীয় বিচারকেরা ছেড়ে দেন। ২১ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের কথা বিবেচনা করে ন্যায়বিচার করার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির চেয়ারপারসন প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে ব্যাপক উন্নয়ন করে দারিদ্র্য কমানো, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সন্ত্রাস দমনের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আরেকবার সুযোগ দিন, বাংলাদেশকে পেছন থেকে পাঁচ বছরে সামনের কাতারে নিয়ে যাব। বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। আর যদি না পারি, তাহলে আপনাদের সামনে আসব না। আমাদের বিশ্বাস, আমরা তা করতে পারব।’
ক্ষমতায় গেলে মাওয়া ও দৌলতদিয়ায় দুটি পদ্মা সেতু করার প্রতিশ্রুতি দেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই। যথাসময়ে নির্বাচন দিতে হবে। আর তা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হবে না।’
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘হল-মার্ক, শেয়ারবাজার, ডেসটিনির টাকা চুরি করে দেশকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। এই টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। কে, কোথায় টাকা পাচার করেছে, তা আমরা জানি। সময়মতো সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া হবে।’
ড. ইউনূসের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না—অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ড. ইউনূসকে দায়ী করে লাভ নেই। আপনি ও আপনার সরকারের ব্যর্থতাই বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য দায়ী। ড. ইউনূস ভালো কাজ করে পুরস্কৃত হয়েছেন। দেশের সম্মান উজ্জ্বল করেছেন।’
১৮ দলীয় জোটের ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে আরও বক্তৃতা করেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান, খেলাফত মজলিসের আমির মো. ইসহাক, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, জামায়াতের মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
বক্তৃতার সুযোগ পায়নি সাত শরিক: ১৮ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ-ভাসানী, মুসলিম লীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কোনো নেতা বক্তৃতার সুযোগ পাননি। এসব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মঞ্চের সামনের সারিতে বসা ছিলেন।
ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষ: খালেদা জিয়ার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে মঞ্চের উল্টো দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ব্যানারের বাঁশ ও চেয়ার ছুড়ে পরস্পর মারামারি করে। এ সময় আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন খালেদা জিয়া মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে উঠছিলেন। পরে বিএনপির নেতারা মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।

No comments

Powered by Blogger.