মালিক দায় চাপালেন কিছু কর্মকর্তার ওপর by শরিফুল হাসান

আগুনে পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, তিনি কোথাও পালিয়ে যাননি। তবে আগুনে পুড়ে ১১১ জনের মৃত্যুর দায় চাপালেন তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা যখন বের হতে চাইছিলেন, তখন কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের বাধা দেন বলে অনেকের বক্তব্যে এসেছে। এ কারণেই এত প্রাণহানি হয়েছে। কাজেই যাঁরা বাধা দিয়েছিলেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। আগুন লাগার দিন ওই কারখানায় এক হাজার ১৩৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, এঁদের মধ্যে ১৪৩ জন বিকেলেই চলে গিয়েছিলেন। বাকিরা কাজ করছিলেন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) কার্যালয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন দেলোয়ার হোসেন। গতকাল বুধবার বিজিএমইএর ডাকে তিনি সেখানে হাজির হন।
প্রথম আলো: আগুন লাগার পর ভবনের তৃতীয় তলায় কার নির্দেশে শ্রমিকদের বের হতে বাধা দেওয়া হয়েছে?
দেলোয়ার হোসেন: একই প্রশ্ন তো আমারও! আহত ও বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা বলেছেন, দুলাল, রাজ্জাক, মঞ্জু ও রানা তাঁদের বের হতে দেননি। আমি তাঁদের কাউকেই এখন ফোনে পাচ্ছি না। তাঁরা মোবাইল ফোন বন্ধ করে পালিয়েছেন।
মো. দুলাল ওই কারখানার মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপক, আবদুর রাজ্জাক কারখানা ব্যবস্থাপক। মোবারক হোসেন মঞ্জু উৎপাদন ব্যবস্থাপক আর সোহেল রানা সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক। অভিযোগ উঠেছে, এঁরাই শ্রমিকদের বের হতে বাধা দিয়েছেন।
প্রথম আলো: তাজরীন ফ্যাশনসের নয়তলা ওই ভবনের নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনি কি এটা জানতেন না?
দেলোয়ার হোসেন: ২০০৮ সালে আমি ভবনটি আরেকজন গার্মেন্টস মালিকের কাছ থেকে কিনে নিই। তখন ভবনটি তিনতলা ছিল। ২০০৯ সালের শেষ দিকে সেখানে তাজরীন গার্মেন্টস চালু করি এবং পরে ওপরে বাড়াই।
প্রথম আলো: ভবনের নিচতলায় একটি গুদাম ছিল। এখানে গুদাম করা কি বৈধ? সেখানে নিরাপত্তা দেয়ালও ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে।
দেলোয়ার হোসেন: আমি অনুমতি নিয়েই গুদাম করেছি। গুদামটি নিরাপদ ছিল। সেখানে কোনো বৈদ্যুতিক লাইন ছিল না। বাইরে থেকে লাইট এনে গুদাম থেকে মালামাল বের করা হতো। আর সেখানে কোনো বিস্ফোরণের শব্দও কেউ শোনেনি।
প্রথম আলো: বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কথা বলেছেন কেউ কেউ। আপনি বলছেন, সেখানে বিদ্যুতের লাইনই নেই। তাহলে গুদামে আগুন লাগল কীভাবে?
দেলোয়ার হোসেন: কারখানার ভেতরের বা বাইরের কোনো মহল চক্রান্ত করে আগুন লাগিয়েছে। না হলে সেখানে আগুন আসবে কোথা থেকে!
প্রথম আলো: অভিযোগ আছে, ব্যাংকের ঋণ থেকে রক্ষা পেতে কিংবা বিমার টাকা পেতেই মালিকপক্ষ থেকে আগুন লাগানো হয়েছে।
দেলোয়ার হোসেন: আমার কারখানার একটি বিমা করা আছে, সেটা মাত্র ১৮ কোটি টাকার। কিন্তু আগুনে তো আমার ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি। তাহলে অল্প কিছু টাকার জন্য কারখানায় আগুন দেব কেন আমি?
প্রথম আলো: আগুন লাগার পর কি আপনি কারখানাটি দেখতে কিংবা শ্রমিকদের সান্ত্বনা দিতে গিয়েছেন?
দেলোয়ার হোসেন: (কান্নাজড়িত কণ্ঠে) আগুন লাগার পর আটটার দিকে আমি কারখানায় গিয়েছিলাম। আমার চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। শ্রমিক-কর্মচারীরা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু ১০টার দিকে কিছু শ্রমিক উত্তেজিত হয়ে উঠলে আমি চলে আসতে বাধ্য হই।
প্রথম আলো: এই আগুন, এত মৃত্যু—এসবের দায় কি আপনি এড়াতে পারেন?
দেলোয়ার হোসেন: ভাই, আমারও তো সন্তান আছে। যাঁদের স্বজন হারিয়েছে, তাঁদের কী বলে আমি সান্ত্বনা দেব! কোটি টাকা দিলেও তো এই ক্ষতি পূরণ হবে না। আমি এই কষ্ট বুঝি। আমি তো কারও জীবন ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে আমার যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারকে আমি দেখব। আর বেঁচে যাওয়া কোনো শ্রমিক আমার অন্য কারখানায় কাজ করতে চাইলে আমি তাঁদের কাজ দেব।
প্রথম আলো: কানাডার একটি পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, আপিন সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, আপনি সুযোগ বুঝে কানাডা চলে যাবেন।
দেলোয়ার হোসেন: নাগরিকত্ব তো দূরের কথা, আমি কখনো কানাডায়ই যাইনি। কানাডার পত্রিকা কীভাবে এটা লিখল, তা আমি বুঝতে পারছি না।

No comments

Powered by Blogger.