প্রশ্নপত্র ফাঁস- অপরাধীরা শাস্তি পায় না কেন? by তুহিন ওয়াদুদ

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাধিতে আক্রান্ত বাংলাদেশ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা যেমন সব স্তরে নেই, আবার যা আছে তা-ও অত্যন্ত সীমিত।


কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা ভর্তির মৌসুমে কিছু কিছু শোনা যায়। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা ছেড়ে দিলে চাকরির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার রেকর্ড পিএসসির (সরকারি কর্মকমিশনের)। একটি নিয়োগ পরীক্ষায় যত রকম দুর্নীতি হওয়ার পথ রয়েছে, তার সবটারই দুয়ার যেন অবারিত। একদিকে অযোগ্য লোকের নিয়োগ, অন্যদিকে দুর্নীতিপরায়ণদের দৌরাত্ম্য, রাষ্ট্রীয় ভূমিকার শৈথিল্য—সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা দৌরাত্ম্য দেখিয়ে চলেছে। সর্বশেষ ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে খবর ছড়িয়ে পড়লে কর্তৃপক্ষ সব লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে। একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, অন্যদিকে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। যে ছেলেটি কোনো দিন ছোট-বড় চাকরির প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, তিনি হয়তো একদিন বিসিএস সম্মানজনক ক্যাডারে চাকরি পাচ্ছেন। যিনি দুর্দান্ত মেধার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ সম্পন্ন করেছেন, তিনি হয়তো বারবার পিছিয়ে পড়ছেন প্রতিযোগিতায়।
এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বলতে হয়। ২৪তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে যখন বাসায় আমি ফিরি, তখন খবর পাই যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রথমে এ কথাটি বিশ্বাস করতে চাইনি। পরে জানা যায়, সত্যি সত্যি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ফলে পরীক্ষাটি বাতিলও করা হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তার পরও কী করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়? একবার সাবরেজিস্ট্রার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা শুনলাম। সেবারও প্রথমে বিশ্বাস করিনি। ঢাকায় আমি যে বাসায় থাকতাম তার পাশের বাসায় আরও কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী থাকতেন। তাঁরা জানতেন আমি বাংলা বিষয়ে লেখাপড়া করেছি। তাঁরা রাতে আমার কাছে প্রায় ২০টি বাংলার প্রশ্নের উত্তর জানতে আসেন। জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা সরল স্বীকারোক্তি দেন যে সাবরেজিস্ট্রার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এগুলো। শুনে শিহরিত হই। আমি কোনো দিন শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো চাকরির পরীক্ষা দিইনি। আমি তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম না বলেই হয়তো তাঁরা আমার কাছে সত্যটা খুলে বলেছিলেন। পরদিন খুব অপেক্ষা করেছিলাম যে সত্যি সত্যি প্রশ্নগুলো মেলে কি না। প্রশ্নগুলো মিলতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, আহত ও হতাশ হয়েছিলাম। জাতীয় দৈনিকে সে কথা প্রকাশিত হলেও সেই পরীক্ষা বাতিল হয়নি। আরও একবার ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি এমন সময় এক পরিচিত ব্যক্তি আমাকে ফোন করে একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি, সেই প্রশ্নটি পরীক্ষায় এসেছে। পরে জানতে পারি, তিনি ৮০টি প্রশ্ন পেয়েছিলেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়কে একসময় শর্ট সাজেশনস হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল। ২০০ প্রশ্ন সাজেশনস আকারে দেওয়া হলে সেখান থেকে ১০০টি পরীক্ষায় আসছে।
প্রত্যক্ষ করা ঘটনার পর থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথাটি শুনলেই এখন মনে হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি সত্যি হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া পিএসসির চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইনের সময়ে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু আবার নতুন করে সেই পুরোনো সংস্কৃতিতে ফিরছে পিএসসি। তা হলে কি পিএসসির চেয়ারম্যানের ব্যর্থতার কারণে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাগুলো হচ্ছে? কারণ, কয়েক দিন আগে থানা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছিল মর্মে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে বিজি প্রেস এবং পিএসসি পরস্পরের দিকে আঙুল নির্দেশ করলেও এ দুই প্রতিষ্ঠান ভিন্ন অন্য কেউ যে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে না, সেটা তো ঠিক। প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি থাকছে নিরাপদে।
বিসিএস পরীক্ষার রাতে অসৎ চাকরিপ্রার্থীরা ফোনে প্রচুর টাকা ফ্লেক্সিলোড করেন। কখনো যদি ফোনে প্রশ্নপত্র তাঁদের কাছে কেউ দিতে চায়, যাতে করে মুঠোফোনেই নিতে পারেন। পরীক্ষার রাতে প্রার্থীরা খুবই কান খাড়া রাখেন কোথাও প্রশ্ন পাওয়া যায় কি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ফিসফাস চলতে থাকে। সত্যি অদ্ভুত এ দেশ!
একের পর এক চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছেই। প্রতিকার নেই, প্রতিরোধ নেই। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে তাদের বিরুদ্ধে গুরু বা লঘু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বহু রকম ক্ষতি সাধিত হয়। কয়েকটি পদের জন্য লাখ লাখ প্রার্থী যান চাকরির পরীক্ষা দিতে। আমাদের দেশে বেকাররা এক দুর্বিষহ সময় অতিক্রম করেন। তার ওপর অনেক চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। তাঁদের প্রতিবার চাকরির আবেদন আর যাতায়াত বাবদ যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা জোগাড় করা একজন বেকারের জন্য কষ্টসাধ্য। অথচ অনেক বছরই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সত্যতা এমন সময়ে পাওয়া যায় যে ততক্ষণে হয়তো পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে চলে গেছে।
শুধু যে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তা নয়। প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, খাদ্য বিভাগের প্রশ্নপত্রসহ প্রায় সব বিভাগের প্রশ্ন ফাঁস হওয়াটা একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেধাবীদের নিরুৎসাহিত করে, বঞ্চিত করে তুলনামূলক কম মেধাবীদের দিয়ে দেশের মঙ্গল সম্ভব নয়।
বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা অনেক মেধাবীর কাছে স্বপ্নের মতো। কত মেধা-শ্রম-সময় দিয়ে একেকজন মেধাবী চেষ্টা করেন তা বর্ণনাতীত। মেধাবীদের শেষ আশ্রয় ছিল একসময় পিএসসি। এখন তাদের শেষ আশ্রয় হতাশা। তা হলে জাতি কীভাবে আশাবাদী হয়ে উঠবে?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.