রাতারগুলের জলাবন-পরিবেশবান্ধব পর্যটনে নজর দিন

সিলেটের রাতারগুল এলাকায় অবস্থিত জলাবনটি হুমকিতে পড়ার খবর সমকালে এমন সময় প্রকাশিত হলো, যখন ওই অঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনা উন্মোচনের দাবিই জোরালো হচ্ছে। আমরা উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলাম যে, অবশেষে বাঙালি তার ঘরকুনো বদনাম ঘুচিয়ে অবসর-বিনোদনমূলক ভ্রমণে মনোযোগ দিচ্ছে।


অস্বীকার করা যাবে না_ আধুনিক পর্যটন বলতে যা বোঝায়, 'সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা' বাংলাদেশে তার প্রসার অনেককাল আশাব্যঞ্জক ছিল না। কিন্তু গত এক দশকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল, বঙ্গোপসাগর সৈকত এবং সুন্দরবনে পর্যটন ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। আমরা দেখছি, সর্বজনীন উৎসব ও পার্বণে আজকাল সবাই নাড়ির টানে ঘরে ফেরেন না। কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েন অদেখার আহ্বানে। তবে বিশ্বব্যাপী কমবেশি হাজার বিলিয়ন ডলারের এ শিল্পের ভাগ নিতে হলে আরও কিছু পর্যটন স্পট চিহ্নিত করা জরুরি_ এই দাবি সমকালের সম্পাদকীয় কলামে একাধিকবার তুলেছি আমরা। পানিপ্রধান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলো সে ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। যমুনা ও পদ্মা নদীকেন্দ্রিক দু'একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়েও উঠেছে। কিন্তু খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের ছায়াঢাকা হিজল-করচ-বরুণ শোভিত এবং অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হাওরাঞ্চলের সম্ভাবনা রয়ে গেছে অনেকাংশে অনুন্মোচিত। গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুলেই দেশের একমাত্র জলাবনটি অবস্থিত_ সেটাই ক'জন জানেন? বিশ্বজুড়ে মাত্র ২২টি 'সোয়াম্প ফরেস্ট' রয়েছে। রাতারগুল তার একটি হলেও আমরা কেবল অভয়ারণ্য ঘোষণা করেই দায় সেরেছি। ওদিকে খাল ইজারা নেওয়ার নামে জলাবনে যাওয়ার জলপথ বন্ধ করা হচ্ছে! রাতারগুল বন নিয়ে এই স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেওয়া যায় না। আমরা আশা করি, খইয়া খালের ওই প্রতিবন্ধক অপসারণে প্রশাসন অবিলম্বে উদ্যোগ নেবে। এলাকাবাসী সাধুবাদ পেতে পারে যে, বনটিতে পর্যটকের যাতায়াত সুবিধার জন্য তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সড়ক নির্মাণ করছে। কিন্তু ভুলে যাওয়া চলবে না, কাজটি আসলে কর্তৃপক্ষের। রাতারগুল জলাবনের যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদের। আবার পর্যটনের চাপে সেখানকার জীববৈচিত্র্য যাতে ক্ষুণ্নম্ন না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি। হাওরাঞ্চলের নিজস্ব উদ্ভিদ হিজল, করচ, বরুণসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ, সাপ-বেজি, গুইসাপসহ বিভিন্ন উভচর প্রাণী এবং নানা প্রজাতির পাখি ও মাছের সমন্বয়ে রাতারগুলে যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা চাপের মুখে ফেলে কেবল পর্যটনের প্রসার আত্মঘাতীই বিবেচিত হবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে ইকো-ট্যুরিজম বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। রাতারগুল ঘিরে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যবান্ধব সেই পর্যটন গড়ে উঠতে পারে অনায়াসে। বস্তুত নেতিবাচক সংবাদের মধ্য দিয়ে পাদপ্রদীপে আসা বনটির ব্যাপারে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি। রাতারগুল সংলগ্ন গোয়াইন নদী, শিমুল বিল ও নেওয়া বিলও বৃহত্তর সেই পর্যটন পরিকল্পনায় স্থান পেতে পারে। এটা ঠিক, ১৯৭৩ সালে যখন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়, তখন 'ইকো-ট্যুরিজম' ধারণাটি দানা বাঁধেনি। এখন সময়ের প্রয়োজনে অভয়ারণ্যটিকে ইকো-ট্যুরিজম স্পট ঘোষণার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা স্বাগতই জানাবেন। রাতারগুলের জলপথ অবারিত, সড়কপথ সচল এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার উদ্যোগ হবে সেই লক্ষ্যের প্রথম ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
 

No comments

Powered by Blogger.